এক যে ছিল রাজা, এক যে ছিল রানী আর এক যে ছিল রাজপুত্তুর । রাজামশায় বয়েসকালে হাট্টাকাট্টা জোয়ান ছিলেন, দেশেবিদেশে যুদ্ধ করেছেন, ঘোড়ায় চড়ে রাজ্যের এ-মুড়ো ও-মুড়ো চষেছেন, চোর-ডাকাত-বদমাশ ধরে রাম-ঠ্যাঙান ঠেঙিয়েছেন । রানী জমকালো শাড়ি পরে, এক-গা গয়না ঝলমলিয়ে সকালে ঠাকুরবাড়ি, বিকেলে অতিথিশালায় পাক মেরেছেন, রাজপ্রাসাদের দাসী-চাকর-খুটি-নাটি-ভিতর-বাহির-পালপার্বণ সামলেছেন, অবরে-সবরে রাজামশায়কে বুদ্ধিও জুগিয়েছেন । এখন দুজনেরি চুলে রুপোলী ঝিলিক, কাগজ পড়তে চশমা লাগে, সিঁড়ি চড়তে হাঁপ ধরে, উঠতে বসতে হাঁটু ঝনঝন কোমর টনটন হাত-পা কনকন। রাজভোগ খেলে বুকজ্বালা ধরে, রাতভোর হাওয়া লাগলেই সকালে হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো । দুজনেরি বয়েস হচ্ছে।
রাজামশায়ের ভারী ইচ্ছে, রাজপুত্তুরকে সিংহাসনে বসিয়ে রিটায়ার করেন। অনেক হয়েছে রাজকাজ, এবার আয়েস করে নাকে চশমা এঁটে গল্পের বই পড়বেন আর তীর্থধর্ম করবেন। তবে তার আগে একটা কাজ বাকি| তাঁদের বংশে অনেক পুরুষের রেওয়াজ, অভিষেকের আগে রাজপুত্তুরের বিয়ে দেওয়া হয়|তাঁর ঠাকুরদার বাবা সাত-তাড়াতাড়ি ছেলেকে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছিলেন, মাসখানেকের মধ্যে ঘোড়া থেকে পড়ে মাথায় চোট লেগে মারা যায় সে ছেলে| সেই থেকে কুলগুরুর কড়া হুকুম, ছেলের মাথায় মুকুট পরাতে চাও ভালো, আগে টোপর পরাও| রাজামশায় অবিশ্যি এসব খুব একটা মানেন-টানেন না, তবে কিনা একটি মাত্তর ছেলে, তার ভালমন্দ কিছু হবে শুনলে মা-বাপের বুক দুরদুর করেই, তাই নিমরাজি হয়েছেন| রানীমা-ও কদিন থেকে বায়না ধরেছেন, এবার ছেলের বিয়ে দাও।
তা বাপু, ছেলের জন্যে টুকটুকে বউ আনতে সাধ না যায় কার? নতুন বউ মল ঝমঝমিয়ে সারা বাড়ি ছুটে বেড়াবে, দুপুরবেলা চাট্টি পাকাচুল তুলে দেবে, ছেলে-বউতে মিষ্টি-মিষ্টি ঝগড়া-খুনসুটি হবে, নাতিনাতনি টলমলে পায়ে হাঁটবে আর আধো-আধো বুলিতে কথা বলবে – বুড়ো বয়েসে এসব দেখতে কেমন সুখ বলো দেখি!
তা রাজারাজড়ার ব্যাপার, যেমন ভাবা তেমনি কাজ| দাও ঘটক লাগিয়ে| বেশি কিছু নয়, একটি গুণী, ভালো মেয়ে চাই, ঝকঝকে বুদ্ধিমতী মিষ্টি স্বভাব|আর রাজার ছেলে যখন, তখন রাজকন্যে হলেই ভালো হয়| ঘটক কত রাজকন্যের খোঁজ আনে, কোথাও কুঁচবরণ কন্যে তার মেঘবরণ চুল, কোন রাজার মেয়ে গাওনা-বাজনায় তুখোড়, গলায় সাতসুর বয়ে যায় যেন ভরা বর্ষার নদী, কোন রাজকুমারী লেখাপড়ায় ওস্তাদ, তর্কে অনেক পণ্ডিতের কান কেটে নিতে পারে, কেউ বা তলোয়ার খেলা, ধনুক চালানোয় দড়, লোকে বলে চোখ বুজে তীর ছুঁড়লেও সে বেঁধে গিয়ে ঠিক জায়গায়।
কিন্তু রাজপুত্তুরের পছন্দ আর হয় না! কাউকে বলে শাঁকচুন্নি, কাউকে বলে দাঁত উঁচু, কারুর গলায় ব্যাং ডাকছে, কারুর হাত-পায়ের গড়ন হাতির মতন। তার বায়না, তার সত্যিকারের রাজকন্যে চাই।
রাজামশায় প্রথমটা ছেলের আবদার মেনেছিলেন, তারপর বিরক্ত হয়ে উঠলেন| থেকে থেকে খেপে লাল হয়ে ওঠেন, উঠতে বসতে ছেলেকে গালাগাল করেন। কেন রে বাপু, তুই কোন কন্দর্পের ছা যে সবকটাকে বাতিল করিস? হ্যাঁ মানছি, চেহারাখানা রাজার ছেলের মতই, লেখাপড়া শিখেছিস মন্দ নয়, যুদ্ধটুদ্ধ জানিস, মাথাটাও দিব্যিই খেলে, কিন্তু এতগুলো মেয়েকে দুমদাম বাতিল করিস কি বলে?এতে আমার মানটা কোথায় থাকে শুনি? এমন গাধা, এটাও জানিস না যে শক্তপোক্ত শ্বশুরবাড়ি থাকলে রাজাদের কলজের জোর বেড়ে যায়? আশেপাশের রাজারা কথায় কথায় তাদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাতে ভয় পায়? আর এত যে প্যাখনা জুড়ছিস, বলি নিজে একখানা মেয়ে পছন্দ করে দেখা দেখি? সে গুড়ে তো স্রেফ বালি!
বাপ-মা মেয়ে খুঁজতে হন্যে হয়ে গেলেন, ছেলের কিন্তু হেলদোল নেই। সে ঘাড় গোঁজ করে শোনে, তারপর শিস দিতে দিতে শিকারে বেরিয়ে পড়ে।এবং অতি অবশ্যই পরের সম্বন্ধটিও নাকচ করে দেয়| তার এক জেদ, সত্যিকারের রাজকন্যা না হলে সে বিয়ে করবে না|তাহলে সত্যিকারের রাজকন্যা তুই বলিস কাকে? না, সেটা সে জানে না, তবে যে কটি মেয়ের কথা হয়েছে তারা কেউ সেরকম নয়|
মাসছয়েক পর রাজামশায় একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন| তবে রে হতচ্ছাড়া! বিয়ে করবি না! বটে! তোর ঘাড় বিয়ে করবে! সকালবেলা রাজসভায় যাওয়ার পথে ছেলের ঘরে উঁকি দিয়ে জানিয়ে দিলেন, এবার যে মেয়েকে দেখে পছন্দ হবে তাকেই ছেলের বউ করবেন| ‘ঘুঁটেকুড়ুনিই হোক আর রাজার মেয়েই হোক, তাকেই বিয়ে করবি তুই, হনুমান কোথাকার!’ ছেলে মন দিয়ে গোঁফ ছাঁটছিল, জবাব দিল না|
সেদিন বিকেল থেকে আকাশ অন্ধকার করে এল, সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি, কড়াত কড়াত বাজ আর সো সো ঝড়|রাজবাড়ির দরজা জানালা দড়াম দড়াম আছড়ে পড়তে লাগল, ঘরের ভিতর ধুলো, শুকনো পাতা উড়ে একেবারে হুলুটথুলুট| সময়ের আগে রাজসভা ডিসমিস হয়ে গেল| দাসদাসী ছোটাছুটি করে সে সব বন্ধ করতে করতেই জলের ছাঁটে বিছানার আধখানা ভিজে উঠল, রাজসভার কার্পেটে জল থইথই| সে সব পালটে, ঘরদোর পরিষ্কার করতে করতে রাত হল| সব সাফসুতরো করে, জল মুছে, ভিজে কাপড়চোপড় শুকুতে দিয়ে, ঝাড়ু লাগিয়ে সকলে নাজেহাল, কোনরকমে শুয়ে পড়তে পারলে বাঁচে| রান্নাবান্নার কথা কারুর মনেই ছিল না এতক্ষণ, চালে ডালে খিচুড়ি বসিয়ে দেওয়া হল, খেয়ে সকলে লম্বা দেবে| সুদর্শন ঠাকুর মনে করে চাট্টি ডিমও ভেজে ফেলল|
খাওয়া শেষ করে উঠে রাজামশায় সবে জলের গেলাসটি মুখে তুলেছেন, রানীমা পানের বাটা নিয়ে জুৎ করে বসেছেন, রাঁধুনি-যোগাড়ের দল খেয়েদেয়ে হাঁড়ি-হেঁসেল তুলে রান্নাঘর ধোয়ামোছা করছে, এমন সময়ে সিংদরজার লোহার কড়াটা ভয়ানক জোরে নড়ে উঠল| সে কি আওয়াজ! যেন খ্যাপা হাতি ধাক্কা দিচ্ছে, দরজাটা উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত শান্তি নেই| রাজার হাত থেকে গেলাসটা পড়ে ঝনঝন করে গড়িয়ে গেল, রানী বিষম খেলেন, রাজপুত্তুর সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নিজের ঘরে যাচ্ছিল, দড়াম করে এক আছাড় খেল| যে যেখানে ছিল উঠতে-পড়তে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দরজার সামনে জড় হল| দরজায় ধাক্কাটা তখনও সমানে চলছে – দুম দুম দুম !
রাঁধুনি বামুনদি শক্তপোক্ত লোক, প্রাণে ভয়ডর কম| একখানা খুন্তি বাগিয়ে ধরে হেঁকে বলল – ‘কে ?’
বাইরে থেকে সাড়া এল, ‘আমি-ই|’ গলাটা মেয়েলি|
সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল| এই ঘোর বর্ষায় শিয়ালকুকুর অব্দি পথে বেরোয় না, মেয়েমানুষ এসে দরজা পিটছে? বললেই হল? কোনো ডাকাতটাকাত এমন গলা করে কথা বলছে না তো? দরজা খুললেই হা রে রে রে করে লাফিয়ে পড়ে কচুকাটা করবে?নাকি – বলতে নেই রাম রাম রাম রাম – সেই তেনারা এসে মশকরা করছেন?
মোটামুটি ঠিক হল, আরেকবার সাড়া নিয়ে দেখা যাক| তেমন বুঝলে দরজা না খুললেই চলবে| এ-দরজা হাতি এনে ভাঙতে হবে, দরজা না খুললে বাইরে থেকে কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবে না| বামুনদি ফের হাঁকল, ‘ আমি কে? নাম বল তবে দোর খুলব|’
এবার ওপাশ থেকে একটা শানানো গলা ঝংকার দিয়ে উঠল|’ আ মোলো ! একলা একটা মেয়েমানুষ ভিজে পান্তাভাত হয়ে গেল তার হুঁশ নেই, উনি নাম জিজ্ঞেস করতে লেগেছেন!বলি, জেরা করবে না দোর খুলবে? অতিথিকে দাঁড় করিয়ে রাখো, এ কেমনধারা ভদ্রতা তোমাদের বাপু?’
সে গলার দাপটে খানিকটা ভেবড়ে গিয়েই বোধহয়, চৈতসিং দারোয়ান দরজার খিলটা খুলে ফেলল| সকলে অবাক হয়ে দেখল, বাইরে ছোটখাট চেহারার একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, কাঁধে একটা ঝোলা, মাথায় টোকা, গা বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে| পিছনে একটি নিরীহ খচ্চর চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভিজছে|
খানিকক্ষণ কারো মুখে কথা সরল না| রানী সবার আগে সামলে নিয়ে শুধোলেন, ‘কে বাছা তুমি, এমন ঝড়ের রাতে পথে বেরিয়েছ?’
মেয়েটা বোধহয় কটকট করে কথা শোনানোর জন্যেই তৈরি ছিল, আচমকা এমন মিষ্টি কথায় একেবারে ভ্যা করে কেঁদে ফেলে বলল, ‘ বড় বিপদে পড়ে আপনাদের কাছে এলাম| বড় অসময়ে এলাম, অপরাধ নেবেন না মা গো|’
রানী দেখলেন, জলে ভিজে মেয়েটা হি হি করে কাঁপছে, এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে জ্বরে পড়বে, নিমুনিয়া হওয়াও আশ্চর্য নয়| তিনি ডাকলেন, ‘ ওসব পরে হবে, আগে তুমি ঘরে এসো দেখি|ইস, ভিজে একেবারে জল হয়ে গেছ যে – আগে শুকনো জামাকাপড় পর, কিছু মুখে দাও, তারপর তোমার সব কথা শুনব|গোপেশ্বর, যা বাবা খচ্চরটাকে আস্তাবলে নিয়ে গিয়ে চাট্টি ঘাসজল দে|’ বলে তিনি তাঁর মহলের দিকে পা বাড়াতেই, তাঁর খাস দাসী গোলাপী আর থাকতে না পেরে বলে ফেলল, ‘দোষ নিও না মা, মেয়েটাকে যে ঘরে তুলছ, কোত্থেকে না কোত্থেকে এসেছে কে জানে! একটা বিপদ হতে কতক্ষণ ! তার চেয়ে বলি কি মা, আজকের রাতটা বরং মন্দিরের চাতালে শুয়ে থাকুক, ছাদটাদ আছে, গায়ে জলও লাগবে না, কাল সকালে ফয়সালা হবে’খন|’ রানী তাকে ধমক দেওয়ার আগেই মেয়েটা একেবারে ফুঁসে উঠে বলল, ‘ইল্লি আর কি!! চাতালে শোবে ! জানিস আমি রাজার মেয়ে ??’
যেই না বলা, বামুনদিদি, বাসনমাজুনি মোক্ষদা, মানদামাসি, পানসাজুনি বিন্তির মা, সকলে হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ল|ওলো দেখ দেখ, বলে কিনা রাজকন্যে ! কালে কালে কতই হল, আরশোলারও পাখা গজাল ! তা বাছা, রংখানা তো কেলে কাঠের মতন, সরময়দার বদলে কি আলকাতরা মেখেছিলে? আবার এসেছে খচ্চরে চড়ে! হো হো, ছ্যা ছ্যা, হি হি হি! হাসি আর থামতে চায় না| তাদের অবশ্য দোষ দেওয়াও যায় না| মেয়েটার রং এমন আহামরি কিছু নয়, পায়ের জুতোয় একপুরু কাদা, চুল চুড়ো করে বাঁধা, গলায় একখানি পদ্মবীজের মালা, হাত খালি| যা পরে আছে তার চেয়ে বামুনদির শাড়িটাও ভালো|
মেয়েটা এবারে কোমরে হাত দিয়ে রুখে দাঁড়াল| ‘তা হ্যা গো ভালোমানুষের বাছারা, কেমন বড় বাড়িতে কাজ কর শুনি? শিক্ষে সহবত কাকে বলে শেখ নি? আর আপনাকেও বলি বাপু রাজামশায়, কুড়ি বছর আগে যে আপনার প্রাণটা রক্ষে করল, জংলি ভূত বলে তাকে একেবারে ভুলে মেরে দিলেন? সাধে আমি আসতে চাই নি! বাবা নেহাত অনেক করে বলল, তাই - আহা, বুড়ো মানুষটা বিছানাতেই পড়ে আছে, কোনদিন চোখ বুজবে আর কাকা আমাদের দূর দূর করে তাড়াবে নয়ত মেরে পুঁতে দেবে| তাই তো বাবা বলল, আপনি নাকি বাবার খুব চেনা, আপনাকে এসে সব জানাতে, তা হলেই নাকি আপনি লোকলস্কর নিয়ে এসে সকলকে সিধে করে দেবেন?
তাই না আমি এত দূর থেকে এত পথ ঠেঙিয়ে আপনার কাছে এলুম! উঃ, দুদিন ধরে না নাওয়া না খাওয়া, শরীরে আমার আর কিছু নেই গো!’ ধপাস করে সে আবার মেঝের উপরে বসে পড়ল|
রাজামশায়ের মাথায় তখন ঝড় বইছে| কি বলছে এই মেয়ে? জংলি ভূত – প্রাণ বাঁচানো, তবে কি – তবে কি – কিন্তু তাই যদি হয়, তবে এতদিন এ কথা তিনি ভুলে থাকলেন কি করে? ধরা ধরা গলায় তিনি বলে উঠলেন – ‘ তুমি মংলুর মেয়ে?’ মেয়েটা ময়লা কাপড়ের খুঁটে নাক মুছে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘তবে?’
রাজামশায়ের শরীর থরথর করে কাঁপছিল, অনেক দিনের পুরনো কথা মনে পড়ছিল| তখন তিনি যুবরাজ, সিংহাসনে তাঁর বাপ, বুড়ো রাজা বসে| শিকারের প্রচন্ড নেশা ছিল তাঁর, মাঝেমাঝেই দলবল জুটিয়ে বেরিয়ে পড়তেন| একদিন একটা বিরাট বনবরাকে তাড়া করতে করতে গভীর বনে ঢুকে পড়েন| গোঁ ধরে জানোয়ারটার পিছনে ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন, সঙ্গের লোকজন কখন পিছিয়ে পড়েছে খেয়াল করেন নি| যখন খেয়াল হল, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয় হয়, ঘন বনের মধ্যে তিনি একা| জন্তুটাকে দেখা যাচ্ছিল না| ঘোড়া থেকে নেমে চারপাশ দেখতে গিয়েই বিপত্তি, কোথায় ছিল বরাটা, এক ঢুসোয় তাঁকে মাটিতে ফেলে কাঁধে সামনের দাঁত বিঁধিয়ে দিল| হাতের বল্লমটা গেঁথে তিনি জানোয়ারটাকে খতম করলেন ঠিকই, কিন্তু কাঁধের জখমটা বিষিয়ে উঠল, সেই সঙ্গে জ্বর| বনের মধ্যে হোচট খেয়ে, বার বার রাস্তা হারিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, মশার কামড় খেয়ে যখন বনের বাইরে বেরোলেন, তখন তাঁর শরীর ভেঙ্গে আসছে, সন্ধে পেরিয়ে রাত নেমেছে| চাঁদের আলোয় চারপাশ দেখে বুঝলেন, একটা গ্রামে এসে পড়েছেন, ছোট ছোট মাটির বাড়ি, খড়ের চাল, দেওয়ালে লতাপাতা আঁকা| দূরে কোথাও মাদল বাজছে| তাঁর আর কিছু বোঝার শক্তি ছিল না, একটা ঘরের দাওয়ায় উঠে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন|
আবছা জ্ঞান ফিরতে দেখলেন, তিনি একটা নিচু খাটিয়ায় শুয়ে, গায়ে প্রচন্ড ব্যথা| সামনে ছোট্ট জানালা দিয়ে রোদ আসছে, আর একটা কানের-পাশে-ফুল-গোঁজা ব্যাকুল মুখ খাটের পাশে বসে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে|শ্রান্তিতে তিনি আবার চোখ বুজলেন| পরের বার ঘুম ভাঙতে বুঝলেন, কাঁধে একটা ফেট্টি বাঁধা, শরীর দুর্বল কিন্তু গায়ের ব্যথাটা নেই| চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, মাটির দেওয়াল, ঘর পরিষ্কার করে নিকোনো, একপাশে একটা কুঁজো| উঠে বসতে যাবেন, দরজার ঝাঁপ ঠেলে একটি কালোকুলো মেয়ে উঁকি দিয়ে তাঁকে এক ঝলক দেখেই এক গাল হেসে কোথায় যেন দৌড়ে পালাল| কিছুক্ষণ পরে হাতে একটা ঘটি নিয়ে ফিরে এল সে, তার পিছু পিছু এক জোয়ান, তেলচকচকে গা, হাতে পায়ে পেশির ঢেউ খেলছে,একটা লাল ধুতি মালকোঁচা মেরে পরা, ঝুঁটি করে বাঁধা চুল| এক গাল হেসে সে শুধোল, ‘কেমন আছিস?’ হেসে ঘাড় নাড়তে সে বিছানার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, ‘তু রাজা বটিস? ঘোড়া চড়িস? যুদ্ধু করিস?’ সেই মংলু সর্দারের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা|
তিনি যে রাজা নন, যুবরাজ, সেটা বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে| অনেকক্ষণ বোঝানোর পর মাথা নেড়ে মংলু বলেছিল, ‘উ, তু ছোট রাজা বটিস?’
মংলু গ্রামের সর্দার, আশপাশের পাঁচখানা গ্রামের লোকে তাকে মানে|যেদিন তিনি তাদের গ্রামে এসে পড়েন সেদিন তাদের পরব ছিল| নাচগান সেরে অনেক রাতে ফিরে তাঁকে দাওয়ায় পড়ে থাকতে দেখে সে ঘরে তুলে আনে| যে কয়েক দিন তিনি অজ্ঞান হয়ে ছিলেন, মংলু আর তার বউ তাঁর সেবা করে, রাত জেগে ওষুধবিষুধ লাগায়, তাঁকে বাঁচিয়ে তোলে| তাঁর জ্ঞান ফিরে আসার পরেও কয়েকদিন বেশি হাঁটাহাঁটি করার ক্ষমতা ছিল না তাঁর, সকাল বিকেল দাওয়ায় চাটাই পেতে বসতেন, মংলু তাঁকে গ্রামের হালহদিশ শুনাত| তার ভারী ইচ্ছে ছিল, ছোট রাজা তাদের গ্রামে থেকে যান|’আজকাল সবাই শহরে চলে যায় রে ছোট রাজা, আমাদের সাথে আর কেউ থাকে না|’
ফিরে আসার সময়ে মংলু তাঁর ঝোলা ভরে দিয়েছিল চাকভাঙ্গা মধু, পথে খেতে দিয়েছিল ঘরে বানানো চালের পিঠে| তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমি তো কিছু নিয়ে আসিনি, এত করলে তোমরা আমার, বলো কি পাঠাব তোমার জন্যে? তোমায় সাহায্য করতে পারলে আমার ভালো লাগবে|’ সাধারণতঃ রাজারাজড়ার কাছে সকলে সোনাদানা, জমিজমা চায়, সেটা ভেবেই তিনি কথাটা বলেছিলেন| মংলু সে সবের ধার দিয়েও গেল না, বরং বলল, ‘ইখানে পাকা রাস্তা নাই, বর্ষায় জল হয়, সাপকাটিতে লোক মরে| একটো রাস্তা বানিয়ে দিস রে| আর যিখান-সিখান থেকে জল খেয়ে অসুখ হয়, ছেল্যারা মরে, কুয়া কাটিয়ে দিস একটো|আর তু আবার আসিস, তুকে ভালো লেগেছে মোর|’
রাজধানীতে সবাই ভেবেছিল যুবরাজ বাঘের পেটে গেছেন, তিনি ফিরে আসতে উৎসব লেগে যায় আর কি! বুড়ো রাজা শয্যা নিয়েছিলেন, ছেলের মুখে সব শুনে সাতদিনের মধ্যে লোকজন পাঠিয়ে গ্রামের রাস্তা বাঁধিয়ে দেন, বড় বড় কুয়ো কাটান অনেকগুলো| শুধু তাই নয়, গ্রামে পাঠশালা খুলে দেন, ওষুধবিষুধ ডাক্তারবদ্যিও পাঠান|
তার পর থেকে অনেকবার ভেবেছেন মংলুর গ্রামে যাবেন, কিন্তু রাজকাজের পাকেচক্রে এত বছর সেটা হয়ে ওঠে নি| সেই মংলুর মেয়ে এসেছে এতদিন পরে!
তাঁর বুকের মধ্যে ঝড় বইছিল, তিনি শুধু ভারী গলায় রানীকে বললেন, ‘ মেয়েটা অনেক দূর থেকে এসেছে, কিছু খাবারদাবারের ব্যবস্থা করে দাও| আর শুকনো কিছু পরতে দাও, যা ভিজেছে, অসুখ করবে|’ রানী তাঁর মুখ দেখে বুঝেছিলেন তাঁর ভেতরে কিছু একটা চলছে| তিনি বুদ্ধিমতী, খোঁচাখুঁচি করলেন না, মেয়েটাকে নিয়ে নিজের মহলে পা বাড়ালেন| তাঁর মাথায় তখন অন্য একটা মতলব ঘোরাফেরা করছে| আড়চোখে তিনি দেখে ফেলেছেন, মেয়েটার কপালে যেখানে দু-এক কুচি চুল লেপ্টে রয়েছে, কান বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে, গুণধর ছেলে তাঁর সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে, যেমন তাকায় পুরুষ তার প্রিয়তমা নারীটির দিকে| যেতে যেতে মনে মনে একচোট হেসে নিলেন তিনি, পথে এসো বাছাধন! কোনো মেয়েই পছন্দ হয় না, কেমন? রোসো, তোমায় দেখাছি মজা!
হাতমুখ ধুয়ে, কাপড়চোপড় পালটে, চুল আঁচড়ে মেয়েটা যখন এসে খেতে বসল, তখন বামুনদিদির দলও ফিসফিস করে বলতে বাধ্য হল, যতটা হ্যাক থু করা হয়েছে ততটা নয়| রংখানা চাপা বটে, কিন্তু নাক মুখ চোখা চোখা, টানা টানা ঝকঝকে চোখ, খাটিয়ে-পিটিয়ে হাত-পা| যখন ঝগড়া করে তখন অন্য কথা, এমনিতে গলার আওয়াজটি মিঠে|
খিচুড়ি শেষ হয়ে গেছিল, চিঁড়ে দই কলা দিয়ে মেয়েটাকে খেতে দেওয়া হল| টুকটাক কথা বলতে বলতে হাত চেটে চেটে খেল, মাঝে একবার ফিক করে হেসে বলল, ‘ বলিহারি যাই আপনাদের সব লোকজনকে|ঘর পরিষ্কার করতে এমন ব্যস্ত যে ভাতে-ভাত করার সময়ও পেল না?’ রানী কাছে বসে খাওয়াতে খাওয়াতে টের পেলেন, ছেলে খাবার ঘরের আশেপাশে অস্থির হয়ে ঘুরঘুর করছে| মেয়েটা সেসবে আমলই দিল না|
মেয়েটা খাওয়া শেষ করে সেখানেই ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়েছে| তাকে কোথায় শুতে দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে রানীর মনে হল, এই মেয়েটার সঙ্গে ছেলের বিয়ে হতে পারে কি? রাজার মুখ দেখে, কথা শুনে তিনি বুঝেছেন, এ মেয়ের বাবা নিশ্চয় তাঁর বিশেষ পরিচিত| ছেলের যে পছন্দ, সে তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়| এই দুর্যোগের রাতে যে অতটা পথ উজিয়ে আসতে পারে, তার সাহসটা ফেলে দেওয়ার মতও নয়| খাওয়ার সময় কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে লেখাপড়া করেছে, হাত-পা দেখে মনে হয় পরিশ্রমীও বটে| আর কি চাই? শুধু একটা জায়গাতেই আটকাচ্ছে| এ মেয়ে সেই ‘সত্যি রাজকন্যে’ তো? একবার পরীক্ষা করে দেখবেন? ক্ষতি কি? দেখাই যাক না|
রানীর হুকুমে তাঁর মহলেই একটা ঘর খুলে দেওয়া হল| রানীমার হুকুমে গোলাপী, সোনালিরা গজগজ করতে করতে খাটের উপর চাপাল কুড়িখানা গদি আর গোটা পনেরো তোষক|তার উপর ঢাকা পড়ল নরম চাদর, কুঁচি-দেওয়া ওয়াড় পরানো তুলোর বালিশ, পরানো হল মিহি জালের মশারি| সে সবের নীচে রানী নিজের হাতে রাখলেন একটি ছোট্ট মটরদানা|
সবাই বেদম ক্লান্ত ছিল, সেদিন রাতে ঘুম হল জব্বর| সকলে যখন বিছানা ছাড়ল, তখন বেশ বেলা হয়েছে, মেঘ কেটে গিয়ে রোদ উঠেছে| মুখ ধুয়ে চায়ের কাপ নিয়ে সকলে খাবার ঘরে গুছিয়ে বসেছে, রাজামশায় রাজসভায় যাবেন বলে কোমরে বেল্ট আঁটছেন, রানী মানদাকে বলে দিচ্ছেন কি কুটনো কুটতে হবে, এমন সময়ে মেয়েটা চোখ রগড়াতে রগড়াতে এসে দরজায় দাঁড়াল|
রানী তাকে ডাকলেন, ‘ এসো| বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?’ সে এসে একটা চেয়ার টেনে গাল ফুলিয়ে বসল| তার চুল উস্কোখুস্কো, চোখের নীচে কালি|
‘কাল রাতে ঘুম হয়েছিল? তুমি কি চা খাও, না দুধ দিতে বলব?’
প্রশ্নটুকু করার যা অপেক্ষা, সঙ্গে সঙ্গে তড়বড় করে মেয়েটা বলতে লাগল, ‘ ঘুম হয়েছে না ছাই ! সারারাত খালি এপাশ আর ওপাশ! মাথাটা ধরে গেছে, মাগো!’
‘তা গদি-তোশকে শোয়ার অভ্যেস না থাকলে কি আর ঘুম আসে বাছা, কুকুরের পেটে ঘি বই তো নয় !’ ফুট কাটল মানদা|
‘তাই নাকি? তা যাও না, ও বিছানায় একবার শুয়ে দেখ না! সারা রাত ধরে পিঠের নিচে কি যেন ফুটেছে, বাপরে! এই নাকি রাজার বাড়ির বিছানা!রাম রাম!’
মানদা নাক কুঁচকোল বটে, কিন্তু রানীমা মনে মনে ভারী খুশি হয়ে উঠলেন| যাক নিশ্চিন্তি, এই মেয়ে একদম খাঁটি রাজকন্যে| অন্য কেউ হলে কেউ ওই মটরদানার কথা বুঝতেই পারত না|
এবার শিগগির রাজামশায়কে দিয়ে ওর বাড়িতে খবর পাঠাতে হবে| ছেলের অমত হবে না তিনি জানেন, যদি বেগড়বাই করেও, তিনি কষে কানমলা দেবেন| মেয়েটাকেও জিজ্ঞেস করতে হবে বই কি| আপত্তি করবে কি? মনে হয় না, বাকিটা নাহয় ছেলে বুঝে নেবে, এমনিতেই তো চোখে হারাচ্ছে! মেয়েটা একটু খরখরি টরটরি আছে, তা হোক| তাঁর গোঁয়ারগোবিন্দ ছেলের জন্যে এমনি একটি মেয়েরই ভা-রি দরকার ছিল|
Jhaalmuri
Spread Creativity. Spread Happiness.