Story by Anindita Das
চিলাপাতা জঙ্গলের মেন্দাবারি ক্যাম্পের বুকিংটা যে পেয়ে যাবো, আশা করিনি।এর আগেও চেষ্টা করে পাইনি বহুবার। শীতের ছুটিতে উত্তরবঙ্গের কোথাও একটা বেড়াতে যাবো ঠিক করেছিলাম। বক্সা-জয়ন্তির সাথে চিলাপাতার জঙ্গলটাও উপভোগ করবো ভাবলাম।সেই রামগুয়া গাছ,যার গা থেকে রক্তের মত লাল রস বের হয়।আর আছে হাতি-বাইসন। এদের জন্যইতো চিলাপাতা এত শিহরণময়।জঙ্গল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যদিও নতুন নয় তাও জঙ্গলে রাত্রিযাপন,এর আগে বহুবার বিফল হয়েছে।গভীর জঙ্গলের ফরেস্ট বাংলোর বুকিং পাওয়া আর শেষ পর্যন্ত সেখানে গিয়ে থাকতে পারার সৌভাগ্য আজ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি।অনেক আশা নিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ট্রেনে চেপে বসলাম, সঙ্গে ট্যুর প্ল্যানার আমার স্ত্রী শ্রীলেখা।
নিউ আলিপুরদুয়ার ষ্টেশনে নেমে আগে থেকে বুক করে রাখা গাড়ির ড্রাইভার রতনজী একটা খারাপ খবর শোনালো। ‘ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিসারেরা হঠাৎ করে এসে পড়েছেন তাই এই অঞ্চলের বেশীরভাগ বনবাংলোর বুকিং বাতিল হয়ে যাচ্ছে,টুরিস্টদের অন্য হোটেলে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা’। শুনেই টেনশন গেল বেড়ে। মালপত্র গাড়িতে তুলে জঙ্গল ভ্রমণের পারমিটের ব্যাপারে কথাবার্তা বলে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট হল। একটু পরেই জঙ্গলের রাস্তায় পড়লাম। নীরব,নিশ্চুপ,শীতের ধূসরতা মেশানো গাছের সারির মাঝ দিয়ে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে,কালো ফিতের মতো। রতনজী বললেন-‘কাল এই রাস্তায় হাতির পাল বেরিয়েছিল,কয়েকটা টুরিস্টদের গাড়ি তাদের সামনে পড়েছে’। এইখানে আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল,যারা জঙ্গলে বেশ কয়েকবার গেছেন তারা খেয়াল করে দেখবেন এখান কার গাইড বা ড্রাইভারদের কথা শুনে মনে হয়,জন্তু-জানয়ারগুলো যেন ঘরের মুরগি-ছাগলের মতো আজ এখানে কাল ওখানে চরে বেড়ায়।অথচ আমরা যারা টুরিস্ট তারা গেলেই আর কিছুই দেখতে পাইনা। একবার গরুমারা ফরেস্টের মেদলা ওয়াচ-টাওয়ারের কাছে গিয়ে শুনলাম দুটো গণ্ডার নাকি জঙ্গলের পাশের গ্রামের কাছে এসে সাতদিন ধরে লড়াই করেছিলো।যদিও আমরা গিয়ে ওয়াচ-টাওয়ার থেকে অনেক কষ্টে গণ্ডারের একটা লেজ ছাড়া কিছু দেখতে পাইনি।তবে এবারের বেড়ানো কোনও জন্তু দেখার তাড়নায় নয়। রাতের জঙ্গলকে খুব কাছ থেকে উপভোগ করার ইচ্ছায়।তা সেটাও প্রায় ভণ্ডুল হওয়ার যোগাড়।
একটা কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে ক্যাম্পের সামনের গাড়ি দাঁড়ালো, সঙ্গে সঙ্গেই খবর এল বুকিং বাতিল ফরেস্ট অফিসারদের সৌজন্যে।শ্রীলেখা আর আবেগ ধরে রাখতে না পেরে হাতের ব্যাগটা মাটিতে ধপ করে ফেলে,তার ওপর বসে ভ্যা করে কেঁদে ফেলল। ওর এই কাণ্ড দেখে বাকিদের সাথে আমিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। সবাইকে অপ্রস্তুত করে দাবি করে বসল কোনও হোটেলে ও থাকবেনা,থাকতে হলে জঙ্গলের ভেতরেই কোথাও ব্যবস্থা করে দিতে হবে।ওর এই কান্না আর বায়না নিয়ে সবাই যখন ব্যস্ত,আমি সেই সুযোগে ঘুরেঘুরে চত্বরটা দেখছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল ক্যাম্পের একদম শেষ প্রান্তে একটা কাঠের কটেজ একটু আলাদা সবার থেকে,তালা বন্ধ ও একটু পরিচর্যার অভাব রয়েছে। একজন ক্যাম্পের কর্মীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম এই ঘরটা সম্বন্ধে। লোকটি জানালেন ঘরটা কয়েক বছর ধরে পরিত্যক্ত,কাউকে দেওয়া হয়না,কারণটা ম্যানেজারবাবু বলতে পারবেন। আমি গিয়ে ম্যানেজারকে ধরলাম,শ্রীলেখাও পাশে চলে এসেছে ততক্ষণে।দুজনে মিলে অনেক ঘ্যানঘ্যানানি,রাগারাগি, কথাবার্তার পর ম্যানেজারবাবু রাজি হলেন। খালি বললেন ‘আপনারা থাকবেন সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে,পুরনো ঘর,বুঝতেই পারছেন।তাছাড়া অফিসারদের চোখে পড়ে গেলে মুশকিল তাই ঘরের পিছনেরর দিকের বারান্দা সংলগ্ন দরজা ব্যবহার করবেন,কেউ যেন দেখতে না পায়’। আমি বললাম ‘নিশ্চিন্ত থাকুন একটা মাত্র রাতের জন্য থাকব,কাল সকালেই বক্সা চলে যাবো আমরা’।
যা পাওয়া যায় তাই সই, বরং এটা আরও অ্যাডভেঞ্চারাস হবে-এই ভেবে ঘন ঘাস আর চোরকাঁটার সারি পেরিয়ে বাংলোর কর্মীর পিছুপিছু ঘরটার পিছন দিক দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। অনেক দিনের বন্ধ ঘরের গুমোট গন্ধ প্রথমেই নাকে এল।তাও মোটামুটি ব্যবহারযোগ্য করতে বলে আমরা জঙ্গল দেখতে বেরিয়ে পড়লাম।রতনজী পারমিট বানিয়ে রেখেছিলেন।আমাদের ঘর পাওয়ার গল্প শুনে কেমন গম্ভীর হয়ে বললেন ‘না থাকলেই পারতেন ওসব পুরনো ঘরে,কোথায় কি পোকা কি সাপ থাকবে’। কথা বলতে বলতেই জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করে গেলাম।লাল মাটির এবড়ো খেবড়ো রাস্তার ঝাঁকুনি আর একটানা ঝিঁঝিঁর শব্দের মধ্যে দিয়ে বিশাল বড়বড় গাছের ডালপালার চাঁদোয়ার তলা দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল।ঝরে পড়া শুকনো পাতা মাড়িয়ে যাওয়া চাকার অদ্ভুত মচমচ আওয়াজ, ময়ূরের ডাক সব মিলিয়ে গা ছমছম ভাব। প্রতি মুহূর্তের উত্তেজনা এই বুঝি কোন হাতি বা বাইসন বেরিয়ে এল।কিন্তু কোথায় কি? যথারীতি হতাশা। এইভাবেই এক সময় পৌঁছে গেলাম নল রাজার গড়। ধ্বংসস্তূপকে ছাপিয়ে,আগাছার স্রোত ছড়িয়ে পড়েছে। সেভাবে কিছুই দেখার নেই তাই গাড়িতে উঠতে যাবো হঠাৎ পিছন থেকে জামার হাতায় টান পড়লো।দেখি একজন স্থানীয় বৃদ্ধ আদিবাসী হিসহিসে গলায় জিজ্ঞেস করল ‘রাজার গড়তো দেখল্যা,রাজার কথাটো শুনব্যা না বাবু’। গল্পের গন্ধে শ্রীলেখা থমকে গেল,-‘আচ্ছা এই খানেই তো রামগুয়া গাছ আছেনা?ঠিক কোথায় আছে?’ তাইত আমারও মনে পড়ে গেলো।বুড়ো মানুষটি চকচকে চোখে বলল ‘গাছ লয়গো মা, গাছ লয়, উরা পাহার্যাদার...’ এবার অবাক হওয়ার পালা অভিশাপে নিবংশ হল রাজার বংশ;খালি রাজার বিশ্বস্ত পাহার্যাদার হয়ে গেল এমনে এক গাছ যার গা থ্যেকে রক্ত ঝরে’... ‘যতসব বাজে গল্প্’-বিড়বিড় করলাম আমি।লোকটা শুনতে পেয়ে বলল ‘নাগো বাবু,এই চিলাপাতা জঙ্গল রহস্যে ভর্যা গো,ইখানে আজও ইমন ঘটনা ঘটে যা তুরা শহুরে বাবুরা বিশ্বেস করবুনি...’ হঠাৎ রতনজী এসে পড়লেন ‘স্যর,জলদি আসুন,এখানে আর দাঁড়াবেন না।তোরশা নদীর ওপর সানসেট দেখবেন চলুন’। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে হাঁফ ছাড়লাম,লোকটা খুবই অস্বস্তিকর। তোরশার জলে রক্তাভ সূর্যের আলোর খেলা দেখে সন্ধ্যের মুখে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। চিতা বাঘের সম্ভাব্য উপস্থিতির জন্য রাত্রি ৮টার পর ক্যাম্পের মাটিতে নামা বারণ। তাই তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে সবাই ঘরে ঢুকে যায়। মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচু কটেজগুলো অনেকটাই নিরাপদ এইদিক থেকে।আমাদের ঘরে রাতের খাবার দিতে আসা কর্মচারী বলরাম একটা হ্যাজাক ধরণের আলো ও দুটো মোমবাতি দিয়ে গেল।বারবার করে বলল কোনও অসুবিধা হলে মোবাইলে ফোন করতে এরপর আরও কিছু বলতে গিয়েও যেন চুপ করে চলে গেল। খাওয়া সেরে পিছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে অরণ্য,রোমাঞ্চকর সেই অনুভূতি।রাতের জঙ্গলের অদ্ভুত কিছু শব্দ আর স্বপ্নালু জগত ঘিরে রইল আমাদের।মাঝেমাঝে পাশের কোদালবস্তি থেকে হিন্দি গানের আওয়াজ ভেসে আসছে।সভ্য জগতের ওইটুকুই ছোঁয়া রয়ে গেছে এই মুহূর্তে।
সারাদিনের ধকল আর পরের দিন সকালে ওঠার তাড়া থাকায় বেশীক্ষণ বাইরে থাকা গেল না,ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রকোপ বাড়ছিল। ঘরে ঢুকেই একটা ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ এলো,আশ্চর্য! এতক্ষণতো ছিলোনা গন্ধটা,হ্যাজাক থেকে আসছে কি?শ্রীলেখা আবার সব দরজা জানালা বন্ধ করতে শুরু করেছে ঠাণ্ডার ভয়ে।ঘরের ছাদের কাছে একটা ঘুলঘুলি আছে সেটা খেয়াল করেনি বেচারি। আমিও কিছু বললাম না।দুটো করে কম্বল আপাদ-মস্তক মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।ঘটনাটা ঘটলো শেষ রাতে ঘুমের মধ্যেই।হঠাৎ যেন মনে হল নাক জ্বালা করছে,গলাটাও যেন বন্ধ হয়ে আসছে। তীব্র শ্বাসকষ্টে ছটফট করে উঠলাম।ঘেমে যাচ্ছে সারা শরীর,কিন্তু গায়ের কম্বল টা ফেলে দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও যেন নেই। অনেক কষ্টে পাশ ফিরে শ্রীলেখাকে ডাকতে যাবো,হাতটা অনেক উপরে উঠে ধপ করে পড়ে গেল।তাকিয়ে দেখি শ্রীলেখা বিছানায় ওপাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে। ডাকার মতো গলায় জোর পাছছিনা,অথচ এখুনি উঠে বাইরে যাওয়া দরকার,ঘরটার মধ্যে দমবন্ধ হয়ে আসছে... একটু বাতাস...একটু খানি খোলা বাতাস...আআহ আআহ...শ্রী...শ্রী...খক খক করে কাশতে কাশতে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। পর মুহূর্তেই চমকে উঠে দেখি,সকালের আলো কটেজের জানলার কাচ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে।শ্রীলেখা কে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে জঙ্গলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে সে।কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখতেই জড়িয়ে ধরল সে, ফুঁপিয়ে উঠে বলল ‘কাল রাতে একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছি আমি...মৃত্যুকে এতো তীব্র ভাবে উপলব্ধি হয়েছে আমার...’ শিউরে উঠলাম আমি,একি!এত আমারি স্বপ্ন...কিকরে সম্ভব!
ভোরের চিলাপাতা পাখিদের কলতানে মুখর হয়ে উঠছে তখন দুজনের বিহ্বলতার মাঝে বলরাম যে কখন চায়ের ট্রে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। আমাদের স্বন্ত্রস্তভাব দেখে কিছু আন্দাজ করেই যেন থমকে গেছে সে। ‘আপনারাও বুঝি স্বপ্নটা দেখলেন’।হাতের ট্রে নামিয়ে বলে চলল সে ... ‘বছর দশেক আগের কথা ,অল্পবয়সী এক ভদ্রলোক স্ত্রী কে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন। এই কটেজটা তখন সদ্য বানানো হয়েছে,তবে electricity না থাকায় রাতে ঘরে ল্যাম্পের ব্যবস্থা থাকতো। ওরা এসেছিলেন গ্রীষ্মের শুরুতে,পোকামাকড়ের উপদ্রব তখন একটু বেশি থাকে ।ভদ্রমহিলার ছিল পোকার ভীতি,তাই রাতে সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন। সারারাত ওই বন্ধ ঘরে, ল্যাম্পের আলোয় ...সকালে ক্যাম্পের লোক অনেক ডাকাডাকি করেও যখন সাড়া পায়না,দরজা ভাঙ্গা হয়।স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তখন মৃত। আমার নিজের চোখে দেখা স্যর...কি বীভৎস সেই দৃশ্য... দুজনের মুখ দিয়ে কালো রস ...।নাহ...পরে পুলিশের কাছে শুনেছি বিষাক্ত গ্যাসে সারা ঘর ভরে গিয়ে ঘুমের মধ্যেই মারা গেছিলেন উনারা।তারপর থেকেই এই ঘরে যারা রাত কাটায় একটা দুঃস্বপ্ন তাড়া করে সারারাত ধরে। অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে এই ঘরের।ওপরে ঘুলঘুলি বানানো হয়েছে,জেনারেটরের সাহায্যে এক সময় আলোর ব্যবস্থাও করা হল।কিন্তু সেই স্বপ্নের বিভীষিকা দূর হলনা। বছরখানেক পর ওপরতলা থেকে আদেশ এল কটেজ বন্ধ করে দেওয়ার। এইজন্য ম্যানেজারবাবু আপনাদের প্রথমে এই ঘরটা দিতে চায়নি।আপনাদেরি মত ছটফটে চনমনে মানুষ দুটো এই চিলাপাতার জঙ্গলে চিরতরে হারিয়ে গেল।সন্ধ্যের পর এইদিকটায় কেউ আসতেও চায় না।আমি নিজে বেশ কয়েকবার রাতে ফাঁকা ঘরে হ্যাজাকের আলো জ্বলতে দেখেছি।এখনকার দিনে কেউ এসব বিশ্বাস করবে বলুন?আপনাদের ড্রাইভারজীও ঘটনাটা জানে। আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল কেন রতনজী ঘরটা নিতে বারন করেছিলেন।
এরপর কিভাবে যে ফিরে এলাম তা আর মনে রাখার নয়। রাখিনি। দুঃস্বপ্ন স্মৃতি দ্রুত মুছে ফেলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। হঠাৎ মাসদুয়েক পর বলরামের ফোন এল... ‘ ঘরটা ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত।কাল থেকেই কাজ শুরু হবে।আপানারাই শেষ রাত কাটিয়েছেন ওই ঘরে তাই ভাবলাম খবরটা দিই। নমস্কার স্যর,ভালো থাকবেন।পারলে আরেকবার ঘুরে যান, এবার আশাকরি আর কোন অসুবিধা হবে না’।
Jhaalmuri Winter Special 2016
Read the full magazine here:
No comments:
Post a Comment
Please share your valuable feedback