সমস্ত আশঙ্কা সত্যি করে রূপচাঁদের বাবা মারা গেলেন,চিকিৎসার
সেরকম সুযোগ নয়া দিয়েই। হেডস্যার ও স্কুলের অন্যান্য স্যারদের অনেক বোঝানো
সত্ত্বেও চাঁদের মা এই শহর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। গ্রামের বাড়িতে অল্প
জমিজমা ও অবিবাহিত কাকার ছোট্ট দোকানের ভরসায়। ঘটনাটা মাত্র মাস দুয়েকের মধ্যে ঘটে
যাওয়ায় , অনির্বাণের ধাক্কাটা সামলে উঠতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো।গত দু বছরে
রূপচাঁদকে অনেক কাছ থেকে দেখেছে সে। তার মেধা,মনের উদারতা, লড়াকু মন অথচ শান্ত ভদ্র ব্যববহার তাকে মুগ্ধ করে রাখত।
শিক্ষক হিসেবে তো বটেই,একজন মানুষ হিসে্বেও চাঁদের বিপদে কিছু করতে না পারার
অসহায়তা সে মন থেকে মেনে নিতে চাইছিল না ।তবে সময় সব ক্ষতপুরনের অব্যর্থ ওষুধ। যে
ছেলেটি ছিল শ্যামনগর বিদ্যাপীঠের গর্ব এবং হয়ে উঠতে পারত স্কুলের সেরা ছাত্র ,তার
সেই সম্ভাবনার ইতি যেন কুঁড়িতেই ফুল ঝরে যাওয়ার মত। এই ঘটনা ভাগ্যের পরিহাস নাকি
পরিস্থিতির শিকার এটাই শুধু আলচ্য বিষয় হয়ে রয়ে গেল। একটা প্রানবন্ত,স্বপ্নালু কিশোর
মনের মৃত্যু ঘটে গেল নিঃশব্দে।
এই
ঘটনার বছর পনের পরের কথা। এই স্কুল আরও বড় হয়েছে ।প্রতি বছর বেশ কিছু ছাত্র ভাল
ফলাফল সহ পাশ করে যায়। নতুন কয়েক জন তরুণ শিক্ষক স্কুলে যোগ দিয়েছেন । তাদের দেখে
অনির্বাণ স্যারএর নিজের কর্মজীবনের শুরুর দিকের কথা মনে পড়ে। এদের একজন পার্থ রায়।সায়েন্সর স্যার , বাড়ি বনগাঁ অঞ্চলে।
শান্ত,ভদ্র নিজের মধ্যে থাকা ছেলেটির স্বভাব একটু অন্যরকম। টিচার্স রুমে এককোনে
নিজেকে যেন লুকিয়ে রাখে সে,অথচ ক্লাস রুমে ছাত্রদের মাঝে নিজেকে অবারিত করে
দেয়।অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ছাত্রদের প্রিয় হয়ে ওঠে সে। আর অদ্ভুত ভাবে সবার কাছে
দরিদ্র মেধাবি ছাত্রদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করে। এই নিয়ে অনির্বাণের কাছেও দু
বার এসেছে।
এক শনিবার অটো বন্ধ থাকায় স্টেশন যাওয়ার জন্য একই রিকশ-তে
দুজনে উঠে বসে। কথায় কথায় নিজের বাড়ির কথা, আর্থিক কষ্টের সাথে বড়ো হয়ে ওঠার কথা বলতে
শুরু করে পার্থ। এরপর বলল -জানেন অনির্বাণদা ,এই স্কুলের সাথে আমি অনেক আগে থেকেই
পরিচিত’ ।অবাক হয় অনির্বাণ-‘কিভাবে?তুমি তো এখানকার ছেলে নও’। পার্থ বলে-‘আমি একটা
সংস্থার সাথে যুক্ত, সেই সংস্থার উদ্যোক্তা যে মানুষটি,যার অশেষ অবদানের জন্য আজ
আমি এখানে পৌছতে পেরেছি।সেই রূপচাঁদ দাদাই বলেছে এই স্কুলের কথা’। অনির্বাণের
বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার ঝড় সামাল দিতে পার্থ বলে চলল তার রুপদাদার কথা। ‘এখান থেকে চলে
যাবার পর ,গ্রামের বাড়িতে কাকার ছোট্ট দোাকানে মন বসতো না রূপচাঁদের। কঠর বাস্তবের
চাপে হারিয়ে যাচ্ছিল জানার ইচ্ছেগুলো। হঠাত একদিন গ্রামের হরিসভায় বসাল ছোট্ট স্কুল।
সারাদিনে দোকানের রোজগার থেকে গরিব ছাত্রছাত্রীদের চাহিদা মেটানো, বড় স্কুল বা
কলেজে ভরতির টাকা সবরকমের সাহায্য দেওয়ার প্রচেষ্টা ছি্ল।গত দশ বছরে ধীরে ধীরে গড়ে
তুলেছে ‘ঠিকানা’ নামের সংস্থা যারা গরিব ছেলেমেয়েদের পাশে থাকার চেষ্টা করে।আপনি
হবেন এর সদস্য?এখন জেলাসদরেও এই নাম পরিচিত’।ল্পজ্জা
নাকি গর্ব ঠইক কিসের যে অনুভুতি অনির্বাণকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল।বঞ্চিত হয়েই সে বুঝেছে
বঞ্চনার জ্বালা।যে কাজ তিনি নিজে পারেননি,তার থেকেও বড়ো কাজ করে হারিয়ে দিয়েছে
তাঁকে।নিজের ছাত্রের কাছে এই পরাজয় যে তার গর্বের বিষয় সেই উপলব্ধিতেই চোখ থেকে
নেমে এল আনন্দাশ্রু।
Story composed by Anindita Das for Kolom
No comments:
Post a Comment
Please share your valuable feedback