নিশ্চুপ, নির্জন, টুপটাপ ঝরে সে…
প্রকৃতির ভরা সাজ ছোট্ট তিনচুলেতে ।
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য কে লেখায় ফুটিয়ে তোলা সহজ কথা নয় । শীতের ছুটিতে ‘তিন চুলে’ বেড়ানোর কথা লিখতে গিয়ে তাই বারবার সেই বিশালতার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি । সহজ সরল এই গ্রাম তিন চুলে সবার কাছে এখনও অচেনা । পশ্চিমবঙ্গের ভ্রমন মানচিত্রে এর পরিচিতি তেমন নেই । তাই যারা নির্জনতার মাঝে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও পাহাড়ি জীবনের স্বাদ নিতে চান তাদের কাছে বেশ নতুনত্বের ছোঁয়া হবে তিন চুলে ।
তিস্তাবাজার থেকে খাড়াই রাস্তা বড়ামাঙ্ওয়া গ্রাম হয়ে সোজা আসছে তিন চুলে । তবে এই রাস্তা বেশ খারাপ ,সারাই চলছে । তুলনা মুলক ভাবে তাকদাহ-পেশক রোড বেশ ভাল,এই পথের পাশের দৃশ্যও মনোহর; প্রথমে তিস্তা ,পরে চায়ের বাগান পথ চলার সঙ্গী হয় ।আবহাওয়া ভালো থাকলে তুষারশৃঙ্গ দৃশ্যমান হয় । তিন চুলেতে থাকার ব্যবস্থা হয় হোমস্টের মাধ্যমে । আমরা গিয়ে উঠলাম অভিরাজ ভাণ্ডারীর হোমস্টেতে । নতুন তাই সামান্য কিছু অসুবিধা থাকলেও বারান্দাতে এসে দাঁড়াতেই সব জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভুলে গেলাম। উলটো দিকের কালিম্পং শহরের বাড়িগুলো পাহাড়ের গায়ে সুন্দরভাবে সাজানো , তার পিছনে ডেলো পাহাড়ের মাথায় ডেলো বাংলো ( এখন বিশেষ কারণে খ্যাত )। অনেক নীচে তিস্তার জল চিকচিক করছে । বহুদূরে বরফে ঢাকা নাথুলা পাস । গ্যাংটক ,লোলেগাওন একটু ঝাপসা দেখা গেলেও সিকিমের নামচি অনেক স্পষ্ট ।
প্রাথমিক দেখা সাক্ষাৎ ও দুপুরের খাওয়া সেরে রওনা দিলাম কেভ পয়েন্ট এর দিকে,গাইড হল বছর সতেরোর অর্পণ । ধুপির জঙ্গলে মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে রাস্তা চলে গেছে । সূর্যের আলো কদাচিৎ ঢোকে তাই স্যাঁতসেঁতে ভাব চারদিকে আর ঠাণ্ডা।কেভপয়েন্টে পৌঁছে দেখলাম উঁচু একটা পাথরের মাথায় আরেকটা ছোট পাথর কেউ যেন সাজিয়ে দিয়েছে । অর্পণ অনেক ভরসা দিলেও শেষ পর্যন্ত একজনই ছোট পাথরের মাথায় ওঠার সাহস দেখাল। এরপর কেভ মানে গুহায় ঢোকার অংশটাও বেশ রোমাঞ্চকর ।মাটি থেকে ফুট পাঁচেক উঁচুতে গুহার মুখ । লম্বায় প্রায় দশ বার ফুট । চওড়ায় ফুট পাঁচেক ,মেঝে ধুলোয় মলিন আর ছাদ বেশ নিচু । মাঝখানে একটা বাঁক আছে ।ঢোকার আর বেরোনোর রাস্তা বা মুখ আলাদা । ফেরার পথে ঘন ঝোপের আস্তরণে মাথার টুপি হারিয়ে গেল । খুঁজতে গিয়ে দেখি গাছের ডালে আটকে আছে । সঙ্কীর্ণ খাড়া পথটায় পা একটু এদিক ওদিক হলেই পাশের খাদে পড়ে যাওয়ার ভয়।
ছোট্ট ট্রেক সেরে ঘরে ফিরতেই চমকে গেলাম , সূর্যাস্তের আলোয় রক্তিম শৃঙ্গ আর তার সামনে একটা দুটো করে জ্বলে উঠছে পাহাড়ের গায়ে আলোর সারি । রাতের কালিম্পং হোক বা দূরের গ্যাংটকের ভাসাভাসা আলো মনকে কেমন আবেশ করে দেয় । কেঁপে উঠি ঠাণ্ডা হাওয়ায় । গরম গরম কফি ও চিকেন পকড়া খেতে খেতে বারান্দাতেই আড্ডা জমে উঠল । অভিরাজ জি ও তার পরিবারের আতিথেয়তার কোনও ত্রুটি পেলামনা । ভোরে উঠতে হবে তাই রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম ,নিচের উপত্যকা থেকে ঠাণ্ডা হাওয়ার ধাক্কায় টিনের চালে হু হু আওয়াজ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম ।
ভোরে ঘুম ভাঙল সত্যি কারের মোরগের আওয়াজে । অত সকালেও অর্পণ হাজির চা হাতে । এরপর চল্লাম চায়ের বাগান এর পথে । পাহাড়ি ঢালে অনেকটা নেমে আসার পর দুদিকে খালি চায়ের গাছ আর পিছনে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা । আজ আকাশ ঘন নীল,কোথাও কোন মেঘের চিহ্ন নেই ।
খবর পেলাম কলকাতায় বৃষ্টি হচ্ছে । দেখা হল বাগানের পাহারাদারের সাথে । কোমরে বড় কুকরি নিয়ে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ঘুরে বেড়ায় সে । অনেক নীচে তার লাল ছাদের বাড়ি । কুড়ি বছর ধরে এই তার কাজ । মনে পড়ে গেল আরণ্যকের কথা । পাথুরে সিঁড়ির পাশে বসে ধ্যান মগ্ন হয়ে পড়ে সে । ফেরার পথে ‘ধাপ চাষের’ খেত জুড়ে লেটুস,টমেটো আর কড়াইশুঁটির বাহার । এত উঁচুতে জলের স্বাভাবিক চাপকে কাজে লাগিয়ে সামান্য বাঁশ আর সরু পাইপ দিয়ে স্প্রিঙ্কলার পদ্ধতিতে জলসেচ করছে । অরগানিক বা ‘জৈব সার প্রয়োগ’ পদ্ধতি এখানকার গ্রামগুলিতে প্রচলিত।
দুপুরের খাবারের পর চললাম তিন চুলে মনাস্ট্রি দেখতে। মনাস্ট্রির পিছনে সানরাইস ভিউ পয়েন্ট । এখান থেকেও উপভোগ করলাম সামনে্র সবুজ পাহাড় – উপত্যকার সারি। ধুপির জঙ্গলের বাঁকে হঠাত দেখা একলা , পথভোলা হরিণের সাথে ।
তিন চুলে থেকে ঘণ্টা খানেকের দূরত্বে যাওয়া যায় কমলালেবুর বাগানে । এখানেও জৈব সার প্রয়োগ পদ্ধতিতে কমলালেবুর চাষ হচ্ছে । এক গ্লাস করে কমলালেবুর রসে বুঁদ হয়ে, হাঁ করে গাছ ভর্তি কমলালেবু দেখে , কমলালেবুর গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে,ফিরে গেলাম হোমস্টেতে । রাতে হুহু করে বওয়া ঠাণ্ডা হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে অর্পণের সহযোগিতায় চিকেন পোড়ানো ও আগুন পোহানো দুই হোলো । ঝলমলে কালিম্পং পাহাড়ের মাথায় কালপুরুষ তখন স্পষ্টভাবে জেগে উঠছে ।
তিন চুলে থেকে দার্জিলিং ও কালিম্পং দুটো শহরই ঘণ্টা খানেকের পথ । তাই ভ্রমণ সূচিতে এই দুটো জায়গাও জুড়ে নেওয়া যায় । তবে পাহাড়ি গ্রাম্য পরিবেশের রেশ নিয়ে ঘরে ফেরার মজা একটু অন্য রকম । তাকদাহ –পেশক রোড ধরে ফেরার পথে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সাথে থেকে হঠাৎ একটা মোড়ের পর বিদায় নিল। এই কদিনের অকিঞ্চিৎ দর্শন লাভের পর আজকের এই বিচ্ছেদ মনকে স্বাভাবিকভাবেই ভারি করে তুললো ।
Travelogue by +Anindita Aditya for Jhaalmuri Winter Special
Read the e-magazine here http://issuu.com/suparnachakraborti/docs/jhaalmuriwinterspecial2015
Previous works by the author
Jhaalmuri
Spread Creativity. Spread Happiness.
Mail : thejhaalmurigang@gmail.com
No comments:
Post a Comment
Please share your valuable feedback