Saturday, April 15, 2017

Jhaalmuri Boisakhi 2017 published

The 10th digital publication of the e-magazine, Jhaalmuri is dedicated to our poets and their creations.  We have a wonderful collection of poems of various flavors and we hope the poems will connect with your feelings at some chord. We also have  exciting stories, art, photography, food story, travelogue and a very special kids section.

A big thanks to #TeamJhaalmuriBoisakhi2017 for sharing your creations and helping make yet another masterpiece. Please share the link and the post to your friends and families for sharing your and your friend's work. 

Download the e-magazine from our website





Happy Reading


.

Thursday, September 29, 2016

Jhaalmuri Puja Special 2016 - published



The ninth digital publication of the English - Bengali e-magazine, Jhaalmuri releases today. Jhaalmuri Durga Puja Special 2016 is filled with variety of literature and art. The variety of genre ranges from tiny stories to long stories, short poems to extended expression of emotion, art by kids to brilliant painting by pros, photography on travel, food and life in general.

Download the e-magazine from our website

http://www.jhaalmuricorner.com/jhaalmuri-durga-puja-2016.html


Subho Mahalaya

Saturday, April 30, 2016

Boisakhi 2016 - Published


Jhaalmuri

Boisakhi 2016 

Download the e-magazine from our website



Spread Creativity. Spread happiness.

Thank you Team Boisakhi for creating the masterpiece.




Tuesday, April 12, 2016

Jhaalmuri Spring Edition - Boisakhi - Releasing Soon



The Spring Edition of Jhaalmuri online magazine is releasing soon.

Share your creativity with us.
e-mail: thejhaalmurigang@gmail.com

Connect with us in Facebook


Saturday, April 9, 2016

Colorz Photo Fiesta - Awards


Jhaalmuri is happy to announce the winners of the
Colorz Photo Fiesta 
photography contest.

The Jury's Choice award goes to Baishali Ghosh for the photograph "Spring is Here"
The People's Choice Award goes to Prasenjit Sen for the photograph of Dal Lake, Kashmir

We thank Urmita Ghosh, home baker and food blogger at Ume's Kitchen (http://umekitchen.blogspot.in/) for sponsoring the awards for the contest.





The top 10 choices by our esteemed judge Indranil Sarkar (http://www.indranilsarkar.com/)  are as follows














Thank you all for participating in the event and spreading colors all over.

Saturday, February 20, 2016

Colorz Photo Fiesta 2016

Hurray !! Colorz Photo Fiesta - The Photography Contest is back. 
Share your best clicks with us
Mail to thejhaalmurigang@gmail.com
Last Date: 10th march


Rules and Regulations:
  • The theme of the photograph should be Colors of the world.
  • Mail your entries to thejhaalmurigang@gmail.com
  • Please provide the following information along with the image:

Your Name:
Email Id:
Image Title:
Image Description:
Device Used : (DSLR/Point and Shoot/Mobile Camera/Others)

  • Maximum number of submission by any individual: 2
  • Photograph submitted should be the original work of the participant.
  • You can capture photograph using Camera, Mobile or any other digital & analog device.
  • Photograph should not contain any obscene, profanity, or should not hurt any religious or public sentiment.
  • Do NOT delete the EXIF information of the photograph
  • Accepted Image format JPEG/JPG
  • Maximum image size: 5 MB
  • Post production is allowed.
  • Photographs submitted in this event can be used by Jhaalmuri in its other publications with mention of the name of the photographer.
  • Last date of submission: 10th March 2016
Jhaalmuri may decide to exclude any photograph from the contest due to violation of any of the rules above or otherwise.

Lets brighten up this Holi with a burst of colors.

Monday, February 1, 2016

সম্রাট ও সুন্দরী


শীতের দুপুরে পুরো উঠোন ঝলমলে রোদে ভরে আছে। আর সেই উঠোনে সম্রাট ও সুন্দরী ছুটে বেড়াচ্ছে। একবার বাইরের বারান্দায় তো একবার পুকুর পারে, কখনো বা রান্না ঘরে ঢুকছে আর কখনো মিনির পেছনে ছুটছে। বাড়ির সবচেয়ে আদরের তারা। জেঠিমা ওদের জন্য দুধ জাল দিচ্ছে, মাছের দুটো বড় পিস ওদের জন্য কড়া করে ভেজে রাখছে। মেঝকা ওদের জন্য বল নিয়ে আসছে।

সারাদিন খেলা, দুষ্টুমি আর দৌড়ে বেড়ানো। বাড়ির কারো এতে আপত্তি ছিল না। কেবল মাত্র ঝুমঝুমি দিদা ওদের সহ্য করতে পারত না। সম্রাট- সুন্দরী দিদার সামনে আসলেই চেঁচিয়ে উঠত “ধাক্কাখাউরা দূর হ!!”

ঝুমঝুমি দিদা এ বাড়ির ভাড়াটে। তার ছেলে ভোলার সাথে পুকুর পারের পাশে দুটো ঘর নিয়ে থাকে। রেশন কার্ড এ দিদার নাম সরলা বালা দেবী। কিন্তু সে ঝুমঝুমি নামেই পরিচিত। কারণহল তার অদ্ভুত বাতিক। পোস্টম্যান দিপক পাল ভুলে ভুলে মানি অর্ডার এর খাম টা হাতে ঠেকিয়ে দিলে সে গালাগাল দিয়ে পুকুর পারে গিয়ে দু বালটি জল ঝম ঝম করে ঢেলে নেবে গায়ে। কাক মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেলে আবার ঝমঝম, সুলেমান মালি নারকেল গাছ থেকে নারকেল পেড়ে রেখে দিয়ে গেলে  আবার ঝমঝম – ঝমঝমের লিস্ট আর শেষ হওয়ার নেই – সেই থেকেই নাম পরে গেল ঝুমঝুমি দিদা। সম্রাট -সুন্দরী ও দিদার পেছনে লাগবে। দিদা ডালের বড়ি উঠোনে শুকোতে দিলেই হল – সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে চলে যাবে কুলোর ওপর দিয়ে।  তারপরেই সেই বিকট চিৎকার - “ধাক্কাখাউরা দূর হ!!” হাতের সামনে যা কিছু পাবে দিদা ছুড়ে দেবে ওদের উপর। এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল সম্রাট ও সুন্দরী এবং ঝুমঝুমি দিদার শীতকাল।

সে এক দিনের ঘটনা। ভোলা মায়ের সাথে তর্কাতর্কি করে সকালে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরল। এমন মাঝে মাঝেই হত। দিদা জানত এ রাগ বেশীক্ষণের নয়। রাতে আবার সে ফিরে আসবে। তাই দিদা গুসা ভাঙানর জন্য ভোলার প্রিয় কাতলা মাছের ঝাল ও শিদল চাটনি বানিয়ে রাখল। রাতে দিদা চোখে ভালো দেখতে পায়না। হ্যারিকেন জালিয়ে রান্না ঘরের পাশে বসে ঠাকুরের নাম জপছিল। তখনি সে পুকুর পারে শব্দ পেল। ভাবল ভোলা ফিরেছে। “কি রে ভুলা, আইসস নি?” কোনও উত্তর নেই। তাহলে রাগ এখনো কমে নি। রান্না ঘরের দরজা খুলে দিয়ে দিদা অন্ধকারে একটা ছায়া মতন দেখতে পেল। “পুকুর পারে কিতা কররে, আয় ঘরো আয়। হাত পা ধুইয়া খাইতে আয়। “ ছায়া মূর্তি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রান্না ঘরের দিকে এগোল। কোণে গোবর রাখা ছিল। ব্যাস, ধড়াম করে পরলেন পা পিছলে। দিদা তো রেগে আগুন – “দেখতে পারস না নি – কানা নি রে?? যা জল ঢাইল্যা আয়।”   

চুপচাপ সে পুকুরে ধুয়ে ঘরে ঢুকল। দিদা ভাত বেড়ে রেখেছে। সে খাওয়া শুরু করল। হঠাৎ দিদার খটকা লাগল। ভোলা কে কেমন যেন লাগছে। দিদা আবার চেঁচাল – “ভুলা, আমার চশমাটা নিয়া আয়” কোনও উত্তর নেই। সে খেতে ব্যস্ত। তারপরেই ঘটনাটা ঘটল। হুরমুর করে ছুটে এসে সম্রাট ও সুন্দরী ছায়া মূর্তির ওপর ঝাপিয়ে পরল। আর তাকে কে বাচায়। আঁচড়ে কামড়ে অবস্থা খারাপ। ঝুমঝুমি দিদা তো পুরো থ। চ্যাঁচামেচি শুনে বাড়ির সকলে ছুটে এলো। হাবু চোর ধরা পরল। দিদা কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছছেন। সম্রাট ও সুন্দরী আবার দৌড়ে চলে গেল বাইরের বারান্দায়। কিছুক্ষণ পর ভোলা ফিরে এলো।  

পর দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই শোনা গেল ঝুমঝুমি দিদার বিকট ডাক “ওই ধাক্কাখাউরা তরা কৈ গেলি রে? এইদিকে আয়” এক বাটি দুধ এনে দিদিমা উঠোনে রাখলেন। সম্রাট ও সুন্দরী গুটিসুটি এসে বাটির পাশে বসল। দিদা নরম সুরে বললেন “ আর আমার বড়ি মারাইস না বুঝছস” দুধ চাটতে চাটতে মিনির প্রিয় বিড়াল ছানা দুটি বলল “মিঁয়াওও”।



Jhaalmuri Winter Special 2016


হিমেল হাওয়া মাঙ্কি টুপি 

Story by +amlan dutta 

কলকাতায় সেরকম শীত পরে না শুনি  আজকাল,  সেরকম করে নাকি  কাক ভোরে কুয়াশা হয় না আগের মতো, আগের মতো মানে কত দূরের কথা সেসব, ওই যখন স্কুলে পড়তাম সেই সব দিন আর কি,  ভোরের স্কুল, ৬ টা ৫  এর প্রেয়ার, এক গ্লাস গরম দুধ  আর মাঙ্কি টুপি। মনে নেই মিল্টন এর ওয়াটার বোতল পাওয়া যেতো, duckback এর ব্যাগ, রাস্তায় জুতোর ফিতে খুলে গেলে বাবা নিচু হয়ে জুতোর ফিতে বেঁধে দিতো, মুখ দিয়ে ধোঁওয়া ছেড়ে বলতাম আমিও তোমার মতো সিগরেট খাচ্ছি, এই সব কত দিন আর আগের কথা, ছুটির দিনে আমার একতলা বাড়ির ছাদে রোদে দেওয়া সব লেপ তোষকের মাঝে সেই শুয়ে শুয়ে কমলালেবু খাবার দিন কি তবে শেষ বিকেলের শীত এর সাথে মিলিয়ে গেল। হতেই পারে না, এই তো কিছুদিন আগেও শীত পড়লে  বাড়িতে একটা নেসকাফের ছোট কৌটো আসত, বাবা অফিস থেকে ফেরার পর মাঝে মাঝে আমিও ভাগ পেতাম, বিশ্বাস করুন এত সাহেব মনে  হত না  নিজেকে, ফেনা ওঠা নেসকাফের থেকে ভালো কিছু আমি আর এ জন্মে খেয়েছি নাকি মনে করতে পারি না, যদিও আমারটাতে ভীষণ বেশি দুধ আর চিনি থাকত, তখন থেকে ছেলের জিভটা তৈরি হয়েছিল বলেই না সে আজকাল দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ায়, কায়দা করে star bucks এ গিয়ে মুখ বদলাতে সে আবার নাকি chai latte খাচ্ছে, সে যখন জাপানে ছিল একবার green tea টা চেষ্টা করেছিল, পারে নি, কিন্তু সে হেরে যায় নি, কলকাতার শীত বুকের ভেতর কড়া নাড়লেই সে একটা chai latte এ খেয়ে নেয়।  আজ থেকে বছর ১৫ আগে মায়ের যে উলের শালগুলো  ঝেড়ে পরে  পাড়ায় আড্ডা দিতে বেরোত, তার গন্ধ ভেসে এলে সে hood টা মাথার ওপর টেনে নেয়, তবু এই হ্তছাড়ার দেশে ঠান্ডা কিছুতে মরে না।  আজও মায়ের শাল থেকে একটু দুরে তার বইমেলা শুয়ে থাকে, টান টান ময়দান, ধুলো ধুলো আকাশ।

বইমেলা টাও দিক ভুল করে ধাপার দিকে চলে গেল, ইতিহাস হয়ে গেল জানেন, লিটল ম্যাগ হাতে কত গুলো ছেলের capstan এর প্যাকেট আর ৭ দিনের পাস পাওয়ার দিন, ওই পায়ের ছাপ আর হাওয়াই চটির দিন। ৫ টাকার ঘুগনি আর আলুর চপ ভাগ করে খাবার দিন, কলকাতায় কি তবে সেরকম শীত পরে না আজকাল। 

শীত কাল বলতে একটা অবধারিত পিকনিক হত, সেই পাড়া পিকনিক, যেখানে মেয়েদের  সাথে ব্যাডমিন্টন খেলার সুযোগ পাওয়া যেত বছরে একবার, খিচুরী হত মশাই, শেষের দিকে আমরা যারা পরিবেষণ করে খেতে বসতাম, একটা দুটো ঠান্ডা বেগুনি আর হলুদ রঙের কিছু একটা জলের মতো, খিচুড়ি ভেবে খেতাম, তৃপ্তি ছিল কিন্তু, matadorএ উঠেই মাথায় একটা মাফলার এর পুঁটুলি করে নিতাম, সুন্দর দেখাত কিন্তু আমাদের, উপায় ও তো ছিল না, কলকাতায় তখন ১২ আর মফস্বলে তো আরো ১ ডিগ্রী কম, হতেই হবে গাছ পালা কত বলুন?

এই সব দেশে আবার মাইনাস ২০-৩০ টেম্পারেচার হয়, কি বোকা বোকা না বাপারটা, একটা চিরহরিত গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মফস্বলের ছেলে কে আর কত আতলামো না নিতে হবে, কি আর করা যাবে, বিদেশ বলে কথা বাবা, ঠান্ডা কি কলকাতার মতো এত সস্তা হবে নাকি। 

জানেন, সেই যে খুব ছোটবেলা যখন মা আমার বেশ সাজগোজ করত, আমি বাবা আর মা শীতের সকালে ময়দানে যেতাম, গঙ্গার ধার, outram ঘাট, মায়ের হাতের বাঁধা রুমালে এখনো বোধহয় সেদিনের কমলালেবুর গন্ধ পাবেন, আমার শীতকাল বুঝি আজকাল সেখানেই থাকে, ময়দানের বুক চিরে যে ট্রামটা খিদিরপুরের দিকে যায় সে কিছু শীতকাল নিয়ে গেছে আমার। কিছুটা ক্লাস ১২ এ জীবনানন্দ খেয়ে নিয়েছে, কিছুটা পরে আছে college - এর সিঁড়িতে, সেই যেবার নীল কার্ডিগান, মুখে শীতের রোদ, মুগ্ধতা আর বোরোলিনে মাখামাখি হয়ে কিছু শীতকাল পরে আছে সেখানে। কিছুটা তো বাবা নিয়ে চলে গেল তারায় ভরা আকাশের নিচে একা ফেলে, কিছুটা পার্ক স্ট্রিট এর নামে লিখে দিয়েছি, কিছুটা বড়দিনের বেছে বেছে সব থেকে ছোট cake টাকে খাইয়েছি, কিছুটা বিলিয়েছি পাড়ার বন্ধুদের, বাকি টুকু শুধু নিজের শীত, যার ভাগ হয় না, যেটা অবুঝ কুয়াশার মতো নেমে আসে আর অসহায় বোঝায়, মন খারাপের ওপারে সান্তা ক্লজ থাকে, তোমারও মোজা উপহারে ভরে যাবে একদিন, ঝকে ঝকে রোদ উঠবে খুব, সব কটা ফুটপাথ এর কুচো কাঁচার দল cake ভাগ করে খাবে, পার্কস্ট্রিটে সেদিন বিকেল থেকে আলো জ্বলে  উঠবে,  সেদিন কেউ আর একা হেঁটে বাড়ি ফিরবে না, সেদিন আমি আমার সব কটা ডাকনাম ফিরে পাব আর আমার সব হারিয়ে যাওয়া বন্ধুরা এক পেগ বেশি খাবে আমার নামে,  কে যে বলে কলকাতায় নাকি শীত পরে না আর?


Jhaalmuri Winter Special 2016

Download the e-magazine from 

Thursday, January 28, 2016

বিস্কুট

Story by +Anamitra Ray 

আম পাতা জোড়া জোড়া
মারব চাবুক ছুটবে ঘোড়া
ওরে বিবি সরে দাঁড়া
আসছে আমার পাগলা ঘোড়া
পাগলা ঘোড়া খেপেছে
বন্দুক ছুঁড়ে মেরেছে
অল রাইট ভেরি গুড
মেম খায় চা-বিস্কুট।

এ হল সেই আগডুম বাগডুম বয়েসের কথা। যারা ছোটো থেকে বড়ো হয়ে বুড়ো হল, যারা ছোটো থেকে বড়ো হচ্ছে বা যাদের এখনও বড়ো হওয়া শুরু হয়নি, তাদের সবার কথা। এই ধরনের ছড়া বা কবিতায় কোনোদিন কোনো লেখক বা লেখিকার নাম লেখা ছিল না। যেটা ছিল, তা হল, শেষ পঙক্তির ডান দিকে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে একটু ছোটো হরফে, ‘প্রচলিত’। তাই আমরা এটুকু জেনে বা শিখেই ক্ষান্ত হয়েছি যে মেম বিস্কুট দিয়ে চা খেয়েছিলেন। আর আমার মতো বিস্কুট-প্রেমীরা আর একটু যোগ করে নিয়েছি নিজে নিজেই—‘বিস্কুট ছাড়া চা খেতে নেই। খাওয়া যায় না। পানসে লাগে।‘

বিস্কুট হল এক অনন্ত মহাকাব্য। এ মহাকাব্যের অনেক অধ্যায়। প্রত্যেক অধ্যায়ের পরতে পরতে রহস্য, রোমাঞ্চ। যাঁরা উচ্চারণ নিয়ে লড়াই করেন, তাঁরা ইংরেজি অভিধান খুলে বোঝানোর চেষ্টা করবেন ‘বিস্কুট’ নয়, ‘বিস্কিট’। কিন্তু, বিস্কুট আমার ভোরের স্বপ্নে, আর বিস্কিট বারান্দা পেরিয়ে রান্নাঘরের তাকের কোনায়।

থিন না মেরি? থিনও, মেরিও। বড়োরা বলবে, মেরি নয়, মারি। শিশুমন বলবে, আমার মেরিই ভালো।

একটা থিন বিস্কুট মানে অনেকটা মনঃসংযোগ। কারণ সুদর্শন চক্রের মতো ‘কিরি কিরি’ ধারওলা একটা থিন বিস্কুটের ধার বরাবর ক্লক ওয়াইজ বা অ্যান্টি ক্লক ওয়াইজ একটু একটু করে কামড়ে কামড়ে একটা নিটোল গোল রূপ দেওয়ার অক্লান্ত চেষ্টা। কখনো সাফল্য, কখনো ব্যর্থতা। তাই থিন বিস্কুটের মোহ জীবন ছাড়ে না।

খুব ছোটোবেলায় মেজোমামু বলেছিল, থিন বিস্কুট খেয়েই জল খাবি না। অম্বল হবে। এই বিশেষ তথ্যটা কোন বইয়ের পরিশিষ্টে লেখা ছিল জানি না, আজ তাই একটা বিস্কুট খেয়ে অনেকটা জল খাই।

পেটুকরাম একের পর এক উলটোপালটা খাবার খেয়ে যেদিন শয্যাশায়ী হল, দুপুরে ভাতের পাতে তার জন্য বরাদ্দ হল আলু, পেঁপে আর কাঁচকলা দিয়ে শ্যামবর্ণ ঝোল সেই প্রবল দুঃখের দিনে পেটুকরামের পাশে যে বন্ধুটি ছিল সে আর কেউ নয়, তার সাধের থিন বিস্কুট। এক বাটি শুকনো মুড়ির ভেতর থেকে লাইটহাউসের মতো মাথা তুলেছিল বিস্কুটের ছোট্ট ছোট্ট টুকরো আর মুড়ির সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে মিশে ছিল বিস্কুটের গুঁড়ো। সেই দুঃখের দিনে তাকেই পেটুকরামের মনে হয়েছিল যেন সাক্ষাৎ ‘দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর কাঁচের তাকে থরে থরে সাজানো কমলা অমৃতি।

থিন বিস্কুটের পর ক্রিম বিস্কুট। টিফিনে দু-পিস স্যান্ডউইচের পাশের ছোট্ট খোপটায়  দু-জোড়া অরেঞ্জ ক্রিম বিস্কুট উঁকি দিলে মনে আনন্দের ঝড় বয়ে যায়। আর কোনোরকমে স্যান্ডউইচ গলাধঃকরণ করেই ক্রিম বিস্কুটের জোড় খুলে নিয়ে জিভ দিয়ে চেটে আগে ক্রিমের স্বাদগ্রহণ, তারপর শুকনো বিস্কুট চিবিয়েই এক ঢোঁক জল।

আর সেই প্রথম দুধের গেলাসে চায়ের লিকার মিশিয়ে খাওয়ার দিন? উত্তেজনায় হাত ফসকে বিস্কুট ডুবে যায় দুধসাগরে আর তৎক্ষণাৎ ফুলে, ফেঁপে একশা। সে আর এক উত্তেজনা।
বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চা-জীবনের সঙ্গে বিস্কুট-জীবনও অন্তরঙ্গভাবে জড়িয়ে গেছে। তাই বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যেই শুধু নয়, কাজে বেরিয়ে রাস্তায় যখন চা-তেষ্টায় প্রাণ ছটফট, তখন পথের ধারে চা-গাড়ির সামনের বেঞ্চে বসেই বিস্কুটের সারি সারি বয়ামের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আর দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চাওয়া, ‘কোনটা? ওই লম্বা, চৌকোটা, গোল বাদাম দেওয়াটা, নাকি, ওই একটা এবড়োখেবড়ো বিস্কুট সব চা-দোকানেই থাকে, সেইটা?’ মূল কথাটা হল, এক কাপ কেন, আণুবীক্ষণিক এক ভাঁড় চা খেলেও সঙ্গে চা-দোকানের একটা বিস্কুট খেতেই হবে। যারা প্রকৃত বিস্কুটপ্রেমী, তারা ডগ-বিস্কুটও সমান আনন্দে, সমান উত্তেজনায় খেয়ে থাকে। এ প্রমাণ আমার কাছে আছে।

মহাকাব্যের আর এক অধ্যায় জুড়ে আছে সেই গোল, গোল নারকোল বিস্কুট, যার ঠিক মাঝখানে খোদাই করে লেখা, ‘BILL’। সেই ‘বিল’ বিস্কুটের চিরন্তন স্বাদ আর কারো বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে মিষ্টির প্লেটের পাশে একটা কি দুটো ‘বিল’ বিস্কুট হঠাৎ আবিষ্কারের আনন্দ (যাকে ‘পুলক’ বললে ঠিক ঠিক বলা হয়) অন্য কোনো দামি, কম দামি, সাধারণ বা তুচ্ছ বিস্কুটও আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি। এই নারকোল বিস্কুট আবার ছোট্ট ছোট্ট আট আনা কয়েনের আকারেও পাওয়া যেত। তবে তা কিন্তু একটা কি দুটো গুনে খাওয়ার নয়। তার মাপ হল ‘মুঠো’। অর্থাৎ, এক মুঠো, দু-মুঠো বিস্কুট।

মহাকাব্যের আর এক অধ্যায়ে আছে ‘নোনতা’ বিস্কুট। সেই মাঝারি আকারের গোল বিস্কুটের গায়ে চারটে ফুটো। নোনতা বিস্কুটের অস্তিত্বের সঙ্গেও নম্বরের যোগ ততটা নেই। কারণ, একটা খাওয়ার পরেই মন বলে ওঠে, আর একটা। তার পর, আর একটা. . .এভাবেই একসময় ‘এক’ হয়ে যায় বহু।

বিস্কুট যখন মহাকাব্য, তখন ব্যাপারটা মোটেও হেলাফেলার নয়। তার একটা মর্যাদা আছে, একটা সম্মান আছে। তাই, একজন প্রকৃত বিস্কুটপ্রেমীকে চিহ্নিত করতে হলে জানতে হবে, তাঁর শৈশবে, কোনো এক শুনশান দুপুরে বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে, তিনি কি চুপি চুপি ফ্রিজ খুলে মাখন আর জ্যামের শিশি বের করে দুটি ‘একক’ বিস্কুটের গায়ে পুরু করে মাখিয়ে, তাদের চেপে ধরে, গা দিয়ে উপচে বেরোনো মাখন বা জ্যাম দু-চোখ বুজে জিভ দিয়ে চেটে খেয়ে দেখেছেন? 



Jhaalmuri Winter Special 2016


Download the full magazine from the website: 



Wednesday, January 27, 2016

আমার মত


কিছু কিছু  মানুষ থাকেন যাদের সান্নিধ্যে  এলে মন আপনা থেকেই ভালো হয়ে যায়। যারা শত রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ, কষ্ট বুকে চেপে রেখে অনাবিল আনন্দে গা ভাসিয়ে দিতে পারেন। পরের দিনটা বাঁচবে্ন কি না তার নিশ্চয়তা নেই জানা সত্ত্বেও তাঁরা আজকের দিনটিকে প্রাণভরে উপভোগ করেন। এমনই একজন মানুষ ছিলেন আমার কাকা, আমার মত।

এই ‘মত’ নামের পেছনে একটা ইতিহাস আছে। আমার জন্মের পরে আমাকে তখনো আমাকে মায়ের কাছে এনে দেওয়া হয়নি। কাকা আমাকে দেখে এসে মাকে বললেন, “বউদি, তোমার মেয়ে দেখতে একেবারে আমার মত হয়েছে”। শুনে মায়ের কি চিন্তা। কারণ কাকার গায়ের রঙ মিশ্‌ কালো। আর ভারতবর্ষে মেয়েদের গায়ের রঙ কালো হওয়া মানে তো ঘোর সর্বনাশ। তাই আমার ভারতীয় মা চিন্তান্বিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে কাকা সকল সময় আমাকে বলতেন, “তুই বড় হয়ে আমার মত হবি”। শুনতে শুনতে আমি কাকাকে মত বলে ডাকতে শুরু করি। উল্টে কাকাও আমাকে মত বলে ডাকতে শুরু করেন এবং আমরা একে অপরের ‘মত’ হয়ে উঠি।
মত ছিল অসম্ভব প্রাণবন্ত একটা মানুষ। তার মাথায় সবসময় বিচিত্র সব বুদ্ধির আনাগোনা হত। আশেপাশের গোমড়ামুখো মানুষগুলোকে নির্মল আনন্দে ভাসিয়ে দিতে মত সদা তৎপর থাকতো। আবালবৃদ্ধবনিতা প্রত্যেকের সাথেই একই ভাবে মিশত মত। কর্মক্ষেত্রেও একই ভাবে জনপ্রিয় ছিল মত। আমরা থাকতাম একটা ছোট পাহাড়ি শহরে। সেখানের বাঙালি সমাজে রসিক মানুষ হিসেবে সবাই মতকে একডাকে চিনত। প্রচুর বন্ধু বান্ধব ছিল মতর। 

মতর চোখের মণি ছিলাম আমি। আমার পুরো ছোটবেলাটাই মতর সংস্পর্শে কেটেছে। অনেক কিছুই আমার মতর কাছে শেখা। মত ছিল আমার ছেলেবেলার বন্ধু, আমার খেলার সাথী, আমার দুষ্টুমির সাগরেদ, আমার আব্দারের জায়গা। আমার বাবারা ছিলেন দশজন ভাইবোন। তাই যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে বাড়িতে প্রচুর লোক জমা হত। আমরা সব খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো, পিসতুতো ভাই বোনেরা মিলে সে কি হুল্লোড় করতাম। আর আমাদের দলপতি হত এক এবং অদ্বিতীয় মত।

আমার বাবার একটাই বিলাসিতা ছিল জীবনে। সেটা হল ছুটির দিনের ঘুম। এক রবিবারে বেলা দশটা পর্যন্ত বাবা ঘুমোচ্ছেন আর তাঁর নাক ডাকছে। মত সেই নাসিকা গর্জন একখানা টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করে রেখেছিল। পরে সেটা শুনে সবার কি হাসি। আর একবার আমার জ্যাঠতুতো দিদি মুক্তার শাশুড়ি মৃত্যুশয্যায়।  সবাই বিমর্ষ। মত ঘটনাচক্রে সেখানে উপস্থিত ছিল। হঠাৎ বলে উঠল, “আমার এখুনি একটা চিঠি লিখতে হবে”। শুনে সবাই বলে উঠল, “কাকে চিঠি লিখবে?” মত বল্‌ল, “মুক্তার শাশুড়ির হাতে মা বাবার (অর্থাৎ আমার স্বর্গতঃ দাদু ঠাকুমার) জন্যে একটা হাত চিঠি পাঠিয়ে দেব”। শুনে সবাই একচোট হাসল। এই ছিল মত। তাঁর আশে পাশে লোক চুপ করে দুঃখ পেয়ে বসে থাকবে, সেটি হবার নয়। 

যেদিন আমি প্রথম স্কুলে ভর্তি হই, সেদিন মায়ের সাথে মতও গিয়েছিল আমাকে নিয়ে। ফেরার পথে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে মত বাসে চেপে অফিসে চলে গিয়েছিল। সেদিন বাসে মতর পকেটমার হয়ে সাতশো টাকা খোয়া গিয়েছিল। সেই থেকে মত ঠাট্টা করে বলতো, “তোর কাছে আমার সাতশো টাকা পাওনা আছে”। আমার বিয়ের দিন আমার বরকেও মত সেই সাতশো টাকার দুঃখ শুনিয়েছিল।
তখন আমার বয়েস বোধহয় সাত বছর। এক রবিবারে মতর শখ হল আমার চুল কেটে দেবে। সেই চুল কাটার পর্ব চলল ঘণ্টাখানেক ধরে। চুল কাটা শেষ হবার পর মত বললো, “বাঃ, ফাইন হয়েছে”। তারপর কোন এক অজ্ঞাত কারণে ব্যস্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেল। এদিকে আয়না দেখে আমার তো চক্ষুস্থির  । এমন ভাবে চুল কাটা হয়েছে যে, যেই দেখছে মুচকি হেসে চলে যাচ্ছে। চুল কোথাও লম্বা, কোথাও ছোট, কোথাও বা স্রেফ খালি। রাগে আগুন হয়ে আমি কাঁচি হাতে মতর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সেদিন যখন মত ফিরেছিল, তখন আমি মতর মাথায় এলোপাথাড়ি কাঁচি চালিয়ে গোছা গোছা চুল কেটে ফেলেছিলাম। পর দিন মতর অফিস আর আমার স্কুল। দুজনেই টুপি পরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম।

আমার বই পড়ার অভ্যেসটাও মতর জন্যেই তৈরি হয়েছিল। মত রোজ শোবার আগে আমাকে বই থেকে গল্প পড়ে শোনাত। আর রোজই গল্পের মাঝপথে এসে থেমে বলতো, “আজ আর নয়, আমার ঘুম পেয়েছে”। বাধ্য হয়ে বাকি গল্পটা আমার নিজেই পড়ে নিতে হত।

মত অনেক কঠিন বিষয়কে সহজ করে বোঝাতে পারত। একটা সামান্য উদাহরণ দিচ্ছি। তখন আমি অনেক নিচু ক্লাসে পড়ি। পরীক্ষার আগের দিন lieutenant বানানটা কিছুতেই শিখতে পারছিনা। মত এসে বললো, “ শোন, এভাবে মনে রাখবি, মিথ্যা তুমি দশটা পিঁপড়া, এই কথাটা ইংরাজিতে অনুবাদ করলেই হয়ে যাবে”। আজও lieutenant বানানটা আমার এভাবেই মনে রয়েছে। মত একবার আমায় বলেছিল, “জানিস, মাত্র ৫০ নম্বরের জন্যে ম্যাট্রিকে আমি অংকে লেটার পাই নি।“ এই রকম ছোট ছোট অসংখ্য ঘটনা আমার স্মৃতিতে ভিড় করে আছে।

আমার এই প্রাণবন্ত, হাস্যরসপ্রিয় মতর শরীরে কঠিন রোগ বাসা বেঁধেছিল। যৌবনে মাত্রাতিরিক্ত ধূমপানের ফলে মতর ফুসফুস দিন দিন জীর্ণ হয়ে পড়ছিল। খুব কষ্ট পেত মত। শ্বাসকষ্ট লেগেই থাকত। কিন্তু এত অসুস্থতার মধ্যেও একটি দিনের জন্যেও মতর মুখের হাসি মিলিয়ে যায়নি। যখনই প্রশ্ন করতাম, “কেমন আছ?”, মত হাসিমুখে বলতো, “ ফাইন, ফাইন”। 

আজ মত নেই। শেষবার যখন শরীর বেশী খারাপ হল, তখন হাসপাতালে যাবার সময় অ্যাম্বুলেন্সে আমার কাঁধে মাথা রেখে মত একটু বাতাস পাবার জন্যে কি আকুলি বিকুলি করছিল। আকারে ইঙ্গিতে আমাকে বলছিল, “এবার আর ফিরে আসবো না”। সেবার এত কষ্টের মধ্যেও হাসপাতালে থাকাকালীন মত আমার জন্মদিন মনে রেখেছিল। এই পৃথিবীতে মতর মত মানুষ খুব কম জন্মায়। তারা শুধু অপরকে আনন্দ দিয়েই যায়। নিজের কষ্ট কাউকে বুঝতে না দিয়ে সবাইকে হাসি গল্পে ভুলিয়ে রাখে। বিনিময়ে কতটা ভালবাসা পেল, তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা থাকেনা। মতর কাছে শেখা জীবনের এই শিক্ষা আমাকে অনেক কঠিন পরিস্থিতিতে সাহায্য করেছে। 


Jhaalmuri Winter Special 2016


Tuesday, January 26, 2016

স্বপ্ন

Story by Anindita Das


চিলাপাতা জঙ্গলের মেন্দাবারি ক্যাম্পের বুকিংটা যে পেয়ে যাবো, আশা করিনি।এর আগেও চেষ্টা করে পাইনি বহুবার। শীতের ছুটিতে উত্তরবঙ্গের কোথাও একটা বেড়াতে যাবো ঠিক করেছিলাম। বক্সা-জয়ন্তির সাথে চিলাপাতার জঙ্গলটাও উপভোগ করবো ভাবলাম।সেই রামগুয়া গাছ,যার গা থেকে রক্তের মত লাল রস বের হয়।আর আছে হাতি-বাইসন। এদের জন্যইতো চিলাপাতা এত শিহরণময়।জঙ্গল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যদিও নতুন নয় তাও জঙ্গলে রাত্রিযাপন,এর আগে বহুবার বিফল হয়েছে।গভীর জঙ্গলের ফরেস্ট বাংলোর বুকিং পাওয়া আর শেষ পর্যন্ত সেখানে গিয়ে থাকতে পারার সৌভাগ্য আজ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি।অনেক আশা নিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ট্রেনে চেপে বসলাম, সঙ্গে ট্যুর প্ল্যানার আমার স্ত্রী শ্রীলেখা।
নিউ আলিপুরদুয়ার ষ্টেশনে নেমে আগে থেকে বুক করে রাখা গাড়ির ড্রাইভার রতনজী একটা খারাপ খবর শোনালো। ‘ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিসারেরা হঠাৎ করে এসে পড়েছেন তাই এই অঞ্চলের বেশীরভাগ বনবাংলোর বুকিং বাতিল হয়ে যাচ্ছে,টুরিস্টদের অন্য হোটেলে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা’। শুনেই টেনশন গেল বেড়ে। মালপত্র গাড়িতে তুলে জঙ্গল ভ্রমণের পারমিটের ব্যাপারে কথাবার্তা বলে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট হল। একটু পরেই জঙ্গলের রাস্তায় পড়লাম। নীরব,নিশ্চুপ,শীতের ধূসরতা মেশানো গাছের সারির মাঝ দিয়ে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে,কালো ফিতের মতো। রতনজী বললেন-‘কাল এই রাস্তায় হাতির পাল বেরিয়েছিল,কয়েকটা টুরিস্টদের গাড়ি তাদের সামনে পড়েছে’। এইখানে আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল,যারা জঙ্গলে বেশ কয়েকবার গেছেন তারা খেয়াল করে দেখবেন এখান কার গাইড বা ড্রাইভারদের কথা শুনে মনে হয়,জন্তু-জানয়ারগুলো যেন ঘরের মুরগি-ছাগলের মতো আজ এখানে কাল ওখানে চরে বেড়ায়।অথচ আমরা যারা টুরিস্ট  তারা গেলেই আর কিছুই দেখতে পাইনা। একবার গরুমারা ফরেস্টের মেদলা ওয়াচ-টাওয়ারের কাছে গিয়ে শুনলাম দুটো গণ্ডার নাকি জঙ্গলের পাশের গ্রামের কাছে এসে সাতদিন ধরে লড়াই করেছিলো।যদিও আমরা গিয়ে ওয়াচ-টাওয়ার থেকে অনেক কষ্টে গণ্ডারের একটা লেজ ছাড়া কিছু দেখতে পাইনি।তবে এবারের বেড়ানো কোনও জন্তু দেখার তাড়নায় নয়। রাতের জঙ্গলকে খুব কাছ থেকে উপভোগ করার ইচ্ছায়।তা সেটাও প্রায় ভণ্ডুল হওয়ার যোগাড়।                                                        

একটা কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে ক্যাম্পের সামনের গাড়ি দাঁড়ালো, সঙ্গে সঙ্গেই খবর এল বুকিং বাতিল ফরেস্ট অফিসারদের সৌজন্যে।শ্রীলেখা আর আবেগ ধরে রাখতে না পেরে হাতের ব্যাগটা মাটিতে ধপ করে ফেলে,তার ওপর বসে ভ্যা করে কেঁদে ফেলল। ওর এই কাণ্ড দেখে বাকিদের সাথে আমিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে  গেলাম। সবাইকে অপ্রস্তুত করে দাবি করে বসল কোনও হোটেলে ও থাকবেনা,থাকতে হলে জঙ্গলের ভেতরেই কোথাও ব্যবস্থা করে দিতে হবে।ওর এই কান্না আর বায়না নিয়ে সবাই যখন ব্যস্ত,আমি সেই সুযোগে ঘুরেঘুরে চত্বরটা দেখছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল ক্যাম্পের একদম শেষ প্রান্তে একটা কাঠের কটেজ একটু আলাদা সবার থেকে,তালা বন্ধ ও একটু পরিচর্যার অভাব রয়েছে। একজন ক্যাম্পের কর্মীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম এই ঘরটা সম্বন্ধে। লোকটি জানালেন ঘরটা কয়েক বছর ধরে পরিত্যক্ত,কাউকে দেওয়া হয়না,কারণটা ম্যানেজারবাবু বলতে পারবেন। আমি গিয়ে ম্যানেজারকে ধরলাম,শ্রীলেখাও পাশে চলে এসেছে ততক্ষণে।দুজনে মিলে অনেক ঘ্যানঘ্যানানি,রাগারাগি, কথাবার্তার পর ম্যানেজারবাবু রাজি হলেন। খালি বললেন ‘আপনারা থাকবেন সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে,পুরনো ঘর,বুঝতেই পারছেন।তাছাড়া অফিসারদের চোখে পড়ে গেলে মুশকিল তাই ঘরের পিছনেরর দিকের বারান্দা সংলগ্ন দরজা ব্যবহার করবেন,কেউ যেন দেখতে না পায়’। আমি বললাম ‘নিশ্চিন্ত থাকুন একটা মাত্র রাতের জন্য থাকব,কাল সকালেই বক্সা চলে যাবো আমরা’।                    
                     
যা পাওয়া যায় তাই সই, বরং এটা আরও অ্যাডভেঞ্চারাস হবে-এই ভেবে ঘন ঘাস আর চোরকাঁটার সারি পেরিয়ে বাংলোর কর্মীর পিছুপিছু ঘরটার পিছন দিক দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। অনেক দিনের বন্ধ ঘরের গুমোট গন্ধ প্রথমেই নাকে এল।তাও মোটামুটি ব্যবহারযোগ্য করতে বলে আমরা  জঙ্গল দেখতে বেরিয়ে পড়লাম।রতনজী পারমিট বানিয়ে রেখেছিলেন।আমাদের ঘর পাওয়ার গল্প শুনে কেমন গম্ভীর হয়ে বললেন ‘না থাকলেই পারতেন ওসব পুরনো ঘরে,কোথায় কি পোকা কি সাপ থাকবে’। কথা বলতে বলতেই জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করে গেলাম।লাল মাটির এবড়ো খেবড়ো রাস্তার ঝাঁকুনি আর একটানা ঝিঁঝিঁর  শব্দের মধ্যে দিয়ে বিশাল বড়বড় গাছের ডালপালার  চাঁদোয়ার তলা দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল।ঝরে পড়া শুকনো পাতা মাড়িয়ে যাওয়া চাকার অদ্ভুত মচমচ আওয়াজ, ময়ূরের ডাক সব মিলিয়ে গা ছমছম ভাব। প্রতি মুহূর্তের উত্তেজনা এই বুঝি কোন হাতি বা বাইসন বেরিয়ে এল।কিন্তু কোথায় কি? যথারীতি হতাশা। এইভাবেই এক সময় পৌঁছে গেলাম নল রাজার গড়। ধ্বংসস্তূপকে ছাপিয়ে,আগাছার স্রোত ছড়িয়ে পড়েছে। সেভাবে কিছুই দেখার নেই তাই গাড়িতে উঠতে যাবো হঠাৎ পিছন থেকে জামার হাতায় টান পড়লো।দেখি একজন স্থানীয় বৃদ্ধ আদিবাসী হিসহিসে গলায় জিজ্ঞেস করল ‘রাজার গড়তো দেখল্যা,রাজার কথাটো শুনব্যা না বাবু’। গল্পের গন্ধে শ্রীলেখা থমকে গেল,-‘আচ্ছা এই খানেই তো রামগুয়া গাছ আছেনা?ঠিক কোথায় আছে?’ তাইত আমারও মনে পড়ে গেলো।বুড়ো মানুষটি চকচকে চোখে বলল ‘গাছ লয়গো মা, গাছ লয়, উরা পাহার‍্যাদার...’ এবার অবাক হওয়ার পালা  অভিশাপে নিবংশ হল রাজার বংশ;খালি রাজার বিশ্বস্ত পাহার‍্যাদার হয়ে গেল এমনে এক গাছ যার গা থ্যেকে রক্ত ঝরে’... ‘যতসব বাজে গল্প্‌’-বিড়বিড় করলাম আমি।লোকটা শুনতে পেয়ে বলল ‘নাগো বাবু,এই চিলাপাতা জঙ্গল রহস্যে ভর‍্যা গো,ইখানে আজও ইমন ঘটনা ঘটে যা তুরা শহুরে বাবুরা বিশ্বেস করবুনি...’ হঠাৎ রতনজী এসে পড়লেন ‘স্যর,জলদি আসুন,এখানে আর দাঁড়াবেন না।তোরশা নদীর ওপর সানসেট দেখবেন চলুন’। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে হাঁফ ছাড়লাম,লোকটা খুবই অস্বস্তিকর। তোরশার জলে রক্তাভ সূর্যের আলোর খেলা দেখে সন্ধ্যের মুখে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। চিতা বাঘের সম্ভাব্য উপস্থিতির জন্য রাত্রি ৮টার পর ক্যাম্পের মাটিতে নামা বারণ। তাই তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে সবাই ঘরে ঢুকে যায়। মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচু কটেজগুলো অনেকটাই নিরাপদ এইদিক থেকে।আমাদের ঘরে রাতের খাবার দিতে আসা কর্মচারী বলরাম একটা হ্যাজাক ধরণের আলো ও দুটো মোমবাতি দিয়ে গেল।বারবার করে বলল কোনও অসুবিধা হলে মোবাইলে ফোন করতে এরপর আরও কিছু বলতে গিয়েও যেন চুপ করে চলে গেল। খাওয়া সেরে পিছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে অরণ্য,রোমাঞ্চকর সেই অনুভূতি।রাতের জঙ্গলের অদ্ভুত কিছু শব্দ আর স্বপ্নালু জগত ঘিরে রইল আমাদের।মাঝেমাঝে পাশের কোদালবস্তি থেকে হিন্দি গানের আওয়াজ ভেসে আসছে।সভ্য জগতের ওইটুকুই ছোঁয়া রয়ে গেছে এই মুহূর্তে।

সারাদিনের ধকল আর পরের দিন সকালে ওঠার তাড়া থাকায় বেশীক্ষণ বাইরে থাকা গেল না,ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রকোপ বাড়ছিল। ঘরে ঢুকেই একটা ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ এলো,আশ্চর্য! এতক্ষণতো ছিলোনা গন্ধটা,হ্যাজাক থেকে আসছে কি?শ্রীলেখা আবার সব দরজা জানালা বন্ধ করতে শুরু করেছে  ঠাণ্ডার ভয়ে।ঘরের ছাদের কাছে একটা ঘুলঘুলি আছে সেটা খেয়াল করেনি বেচারি। আমিও কিছু বললাম না।দুটো করে কম্বল আপাদ-মস্তক মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।ঘটনাটা ঘটলো শেষ রাতে ঘুমের মধ্যেই।হঠাৎ যেন মনে হল নাক জ্বালা করছে,গলাটাও যেন বন্ধ হয়ে আসছে। তীব্র শ্বাসকষ্টে ছটফট করে উঠলাম।ঘেমে যাচ্ছে সারা শরীর,কিন্তু গায়ের কম্বল টা ফেলে দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও যেন নেই। অনেক কষ্টে পাশ ফিরে শ্রীলেখাকে ডাকতে যাবো,হাতটা অনেক  উপরে উঠে ধপ করে পড়ে গেল।তাকিয়ে দেখি শ্রীলেখা বিছানায় ওপাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে। ডাকার মতো গলায় জোর পাছছিনা,অথচ এখুনি উঠে বাইরে যাওয়া দরকার,ঘরটার মধ্যে দমবন্ধ হয়ে আসছে... একটু বাতাস...একটু খানি খোলা বাতাস...আআহ আআহ...শ্রী...শ্রী...খক খক করে কাশতে কাশতে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। পর মুহূর্তেই চমকে উঠে দেখি,সকালের আলো কটেজের জানলার কাচ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে।শ্রীলেখা কে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে জঙ্গলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে সে।কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখতেই জড়িয়ে ধরল সে, ফুঁপিয়ে উঠে বলল ‘কাল রাতে একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছি আমি...মৃত্যুকে এতো তীব্র ভাবে উপলব্ধি হয়েছে আমার...’ শিউরে উঠলাম আমি,একি!এত আমারি স্বপ্ন...কিকরে সম্ভব!

ভোরের চিলাপাতা পাখিদের  কলতানে মুখর হয়ে উঠছে তখন দুজনের বিহ্বলতার মাঝে বলরাম যে কখন চায়ের ট্রে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। আমাদের স্বন্ত্রস্তভাব দেখে কিছু আন্দাজ করেই যেন থমকে গেছে সে। ‘আপনারাও বুঝি স্বপ্নটা দেখলেন’।হাতের ট্রে নামিয়ে বলে চলল সে ... ‘বছর দশেক আগের কথা ,অল্পবয়সী এক ভদ্রলোক স্ত্রী কে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন। এই কটেজটা তখন সদ্য বানানো হয়েছে,তবে electricity না থাকায় রাতে ঘরে ল্যাম্পের ব্যবস্থা থাকতো। ওরা এসেছিলেন গ্রীষ্মের শুরুতে,পোকামাকড়ের উপদ্রব তখন একটু বেশি থাকে ।ভদ্রমহিলার ছিল পোকার ভীতি,তাই রাতে সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন। সারারাত ওই বন্ধ ঘরে, ল্যাম্পের আলোয় ...সকালে ক্যাম্পের লোক অনেক ডাকাডাকি করেও যখন সাড়া পায়না,দরজা ভাঙ্গা হয়।স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তখন মৃত। আমার নিজের চোখে দেখা স্যর...কি বীভৎস সেই দৃশ্য... দুজনের মুখ দিয়ে কালো রস ...।নাহ...পরে পুলিশের কাছে শুনেছি বিষাক্ত গ্যাসে সারা ঘর ভরে গিয়ে ঘুমের মধ্যেই মারা গেছিলেন উনারা।তারপর থেকেই এই ঘরে যারা রাত কাটায় একটা দুঃস্বপ্ন তাড়া  করে সারারাত ধরে। অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে এই ঘরের।ওপরে ঘুলঘুলি বানানো হয়েছে,জেনারেটরের সাহায্যে এক সময় আলোর ব্যবস্থাও করা হল।কিন্তু সেই স্বপ্নের বিভীষিকা দূর হলনা। বছরখানেক পর ওপরতলা থেকে আদেশ এল কটেজ বন্ধ করে দেওয়ার। এইজন্য ম্যানেজারবাবু আপনাদের প্রথমে এই ঘরটা দিতে চায়নি।আপনাদেরি মত ছটফটে চনমনে মানুষ দুটো এই চিলাপাতার জঙ্গলে চিরতরে হারিয়ে গেল।সন্ধ্যের পর এইদিকটায় কেউ আসতেও চায় না।আমি নিজে বেশ কয়েকবার রাতে ফাঁকা ঘরে হ্যাজাকের আলো জ্বলতে দেখেছি।এখনকার দিনে কেউ এসব বিশ্বাস করবে বলুন?আপনাদের ড্রাইভারজীও ঘটনাটা জানে। আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল কেন রতনজী ঘরটা নিতে বারন করেছিলেন।  
                                   
এরপর কিভাবে যে ফিরে এলাম তা আর মনে রাখার নয়। রাখিনি। দুঃস্বপ্ন স্মৃতি দ্রুত মুছে ফেলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। হঠাৎ মাসদুয়েক পর বলরামের ফোন এল... ‘ ঘরটা ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত।কাল থেকেই কাজ শুরু হবে।আপানারাই শেষ রাত কাটিয়েছেন ওই ঘরে তাই ভাবলাম খবরটা দিই। নমস্কার স্যর,ভালো থাকবেন।পারলে আরেকবার ঘুরে যান, এবার আশাকরি আর কোন অসুবিধা হবে না’।                      
Jhaalmuri Winter Special 2016


Read the full magazine here: 







Saturday, January 16, 2016

Jhaalmuri Winter Special 2016 published

Jhaalmuri Winter Special 2016 is published

Visit our website to read the e-magazine and share it with your friends






Happy reading !!!!!!!

Sunday, October 11, 2015

Jhaalmuri Puja Special 2015 Published


Jhaalmuri Durga Puja Special 2015 is published

Visit our website to read the e-magazine and share it with your friends




Subho Mahalaya
Wish you a very happy  Durga Puja

Sunday, August 30, 2015

রাজকন্যে ও মটরদানা

এক যে ছিল রাজা, এক যে ছিল রানী আর এক যে ছিল রাজপুত্তুর । রাজামশায় বয়েসকালে হাট্টাকাট্টা জোয়ান ছিলেন, দেশেবিদেশে যুদ্ধ করেছেন, ঘোড়ায় চড়ে রাজ্যের এ-মুড়ো ও-মুড়ো চষেছেন, চোর-ডাকাত-বদমাশ ধরে রাম-ঠ্যাঙান ঠেঙিয়েছেন । রানী জমকালো শাড়ি পরে, এক-গা গয়না ঝলমলিয়ে সকালে ঠাকুরবাড়ি, বিকেলে অতিথিশালায় পাক মেরেছেন, রাজপ্রাসাদের দাসী-চাকর-খুটি-নাটি-ভিতর-বাহির-পালপার্বণ সামলেছেন, অবরে-সবরে রাজামশায়কে বুদ্ধিও জুগিয়েছেন । এখন দুজনেরি চুলে রুপোলী ঝিলিক, কাগজ পড়তে চশমা লাগে, সিঁড়ি চড়তে হাঁপ ধরে, উঠতে বসতে হাঁটু ঝনঝন কোমর টনটন হাত-পা কনকন। রাজভোগ খেলে বুকজ্বালা ধরে, রাতভোর হাওয়া লাগলেই সকালে হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো । দুজনেরি বয়েস হচ্ছে।

রাজামশায়ের ভারী ইচ্ছে, রাজপুত্তুরকে সিংহাসনে বসিয়ে রিটায়ার করেন। অনেক হয়েছে রাজকাজ, এবার আয়েস করে নাকে চশমা এঁটে গল্পের বই পড়বেন আর তীর্থধর্ম করবেন। তবে তার আগে একটা কাজ বাকি| তাঁদের বংশে অনেক পুরুষের রেওয়াজ, অভিষেকের আগে রাজপুত্তুরের বিয়ে দেওয়া হয়|তাঁর ঠাকুরদার বাবা সাত-তাড়াতাড়ি ছেলেকে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছিলেন, মাসখানেকের মধ্যে ঘোড়া থেকে পড়ে মাথায় চোট লেগে মারা যায় সে ছেলে| সেই থেকে কুলগুরুর কড়া হুকুম, ছেলের মাথায় মুকুট পরাতে চাও ভালো, আগে টোপর পরাও| রাজামশায় অবিশ্যি এসব খুব একটা মানেন-টানেন না, তবে কিনা একটি মাত্তর ছেলে, তার ভালমন্দ কিছু হবে শুনলে মা-বাপের বুক দুরদুর করেই, তাই নিমরাজি হয়েছেন| রানীমা-ও কদিন থেকে বায়না ধরেছেন, এবার ছেলের বিয়ে দাও।

তা বাপু, ছেলের জন্যে টুকটুকে বউ আনতে সাধ না যায় কার? নতুন বউ মল ঝমঝমিয়ে সারা বাড়ি ছুটে বেড়াবে, দুপুরবেলা চাট্টি পাকাচুল তুলে দেবে, ছেলে-বউতে মিষ্টি-মিষ্টি ঝগড়া-খুনসুটি হবে, নাতিনাতনি টলমলে পায়ে হাঁটবে আর আধো-আধো বুলিতে কথা বলবে – বুড়ো বয়েসে এসব দেখতে কেমন সুখ বলো দেখি!

তা রাজারাজড়ার ব্যাপার, যেমন ভাবা তেমনি কাজ| দাও ঘটক লাগিয়ে| বেশি কিছু নয়, একটি গুণী, ভালো মেয়ে চাই, ঝকঝকে বুদ্ধিমতী মিষ্টি স্বভাব|আর রাজার ছেলে যখন, তখন রাজকন্যে হলেই ভালো হয়| ঘটক কত রাজকন্যের খোঁজ আনে, কোথাও কুঁচবরণ কন্যে তার মেঘবরণ চুল, কোন রাজার মেয়ে গাওনা-বাজনায় তুখোড়, গলায় সাতসুর বয়ে যায় যেন ভরা বর্ষার নদী, কোন রাজকুমারী লেখাপড়ায় ওস্তাদ, তর্কে অনেক পণ্ডিতের কান কেটে নিতে পারে, কেউ বা তলোয়ার খেলা, ধনুক চালানোয় দড়, লোকে বলে চোখ বুজে তীর ছুঁড়লেও সে বেঁধে গিয়ে ঠিক জায়গায়।

কিন্তু রাজপুত্তুরের পছন্দ আর হয় না! কাউকে বলে শাঁকচুন্নি, কাউকে বলে দাঁত উঁচু, কারুর গলায় ব্যাং ডাকছে, কারুর হাত-পায়ের গড়ন হাতির মতন। তার বায়না, তার সত্যিকারের রাজকন্যে চাই।

রাজামশায় প্রথমটা ছেলের আবদার মেনেছিলেন, তারপর বিরক্ত হয়ে উঠলেন| থেকে থেকে খেপে লাল হয়ে ওঠেন, উঠতে বসতে ছেলেকে গালাগাল করেন। কেন রে বাপু, তুই কোন কন্দর্পের ছা যে সবকটাকে বাতিল করিস? হ্যাঁ মানছি, চেহারাখানা রাজার ছেলের মতই, লেখাপড়া শিখেছিস মন্দ নয়, যুদ্ধটুদ্ধ জানিস, মাথাটাও দিব্যিই খেলে, কিন্তু এতগুলো মেয়েকে দুমদাম বাতিল করিস কি বলে?এতে আমার মানটা কোথায় থাকে শুনি? এমন গাধা, এটাও জানিস না যে শক্তপোক্ত শ্বশুরবাড়ি থাকলে রাজাদের কলজের জোর বেড়ে যায়? আশেপাশের রাজারা কথায় কথায় তাদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাতে ভয় পায়? আর এত যে প্যাখনা জুড়ছিস, বলি নিজে একখানা মেয়ে পছন্দ করে দেখা দেখি? সে গুড়ে তো স্রেফ বালি!

বাপ-মা মেয়ে খুঁজতে হন্যে হয়ে গেলেন, ছেলের কিন্তু হেলদোল নেই। সে ঘাড় গোঁজ করে শোনে, তারপর শিস দিতে দিতে শিকারে বেরিয়ে পড়ে।এবং অতি অবশ্যই পরের সম্বন্ধটিও নাকচ করে দেয়| তার এক জেদ, সত্যিকারের রাজকন্যা না হলে সে বিয়ে করবে না|তাহলে সত্যিকারের রাজকন্যা তুই বলিস কাকে? না, সেটা সে জানে না, তবে যে কটি মেয়ের কথা হয়েছে তারা কেউ সেরকম নয়|

মাসছয়েক পর রাজামশায় একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন| তবে রে হতচ্ছাড়া! বিয়ে করবি না! বটে! তোর ঘাড় বিয়ে করবে! সকালবেলা রাজসভায় যাওয়ার পথে ছেলের ঘরে উঁকি দিয়ে জানিয়ে দিলেন, এবার যে মেয়েকে দেখে পছন্দ হবে তাকেই ছেলের বউ করবেন| ‘ঘুঁটেকুড়ুনিই হোক আর রাজার মেয়েই হোক, তাকেই বিয়ে করবি তুই, হনুমান কোথাকার!’ ছেলে মন দিয়ে গোঁফ ছাঁটছিল, জবাব দিল না|

সেদিন বিকেল থেকে আকাশ অন্ধকার করে এল, সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি, কড়াত কড়াত বাজ আর সো সো ঝড়|রাজবাড়ির দরজা জানালা দড়াম দড়াম আছড়ে পড়তে লাগল, ঘরের ভিতর ধুলো, শুকনো পাতা উড়ে একেবারে হুলুটথুলুট| সময়ের আগে রাজসভা ডিসমিস হয়ে গেল| দাসদাসী ছোটাছুটি করে সে সব বন্ধ করতে করতেই জলের ছাঁটে বিছানার আধখানা ভিজে উঠল, রাজসভার কার্পেটে জল থইথই| সে সব পালটে, ঘরদোর পরিষ্কার করতে করতে রাত হল| সব সাফসুতরো করে, জল মুছে, ভিজে কাপড়চোপড় শুকুতে দিয়ে, ঝাড়ু লাগিয়ে সকলে নাজেহাল, কোনরকমে শুয়ে পড়তে পারলে বাঁচে| রান্নাবান্নার কথা কারুর মনেই ছিল না এতক্ষণ, চালে ডালে খিচুড়ি বসিয়ে দেওয়া হল, খেয়ে সকলে লম্বা দেবে| সুদর্শন ঠাকুর মনে করে চাট্টি ডিমও ভেজে ফেলল|

খাওয়া শেষ করে উঠে রাজামশায় সবে জলের গেলাসটি মুখে তুলেছেন, রানীমা পানের বাটা নিয়ে জুৎ করে বসেছেন, রাঁধুনি-যোগাড়ের দল খেয়েদেয়ে হাঁড়ি-হেঁসেল তুলে রান্নাঘর ধোয়ামোছা করছে, এমন সময়ে সিংদরজার লোহার কড়াটা ভয়ানক জোরে নড়ে উঠল| সে কি আওয়াজ! যেন খ্যাপা হাতি ধাক্কা দিচ্ছে, দরজাটা উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত শান্তি নেই| রাজার হাত থেকে গেলাসটা পড়ে ঝনঝন করে গড়িয়ে গেল, রানী বিষম খেলেন, রাজপুত্তুর সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নিজের ঘরে যাচ্ছিল, দড়াম করে এক আছাড় খেল| যে যেখানে ছিল উঠতে-পড়তে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দরজার সামনে জড় হল| দরজায় ধাক্কাটা তখনও সমানে চলছে – দুম দুম দুম !

রাঁধুনি বামুনদি শক্তপোক্ত লোক, প্রাণে ভয়ডর কম| একখানা খুন্তি বাগিয়ে ধরে হেঁকে বলল – ‘কে ?’

বাইরে থেকে সাড়া এল, ‘আমি-ই|’ গলাটা মেয়েলি|

সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল| এই ঘোর বর্ষায় শিয়ালকুকুর অব্দি পথে বেরোয় না, মেয়েমানুষ এসে দরজা পিটছে? বললেই হল? কোনো ডাকাতটাকাত এমন গলা করে কথা বলছে না তো? দরজা খুললেই হা রে রে রে করে লাফিয়ে পড়ে কচুকাটা করবে?নাকি – বলতে নেই রাম রাম রাম রাম – সেই তেনারা এসে মশকরা করছেন?

মোটামুটি ঠিক হল, আরেকবার সাড়া নিয়ে দেখা যাক| তেমন বুঝলে দরজা না খুললেই চলবে| এ-দরজা হাতি এনে ভাঙতে হবে, দরজা না খুললে বাইরে থেকে কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবে না| বামুনদি ফের হাঁকল, ‘ আমি কে? নাম বল তবে দোর খুলব|’

এবার ওপাশ থেকে একটা শানানো গলা ঝংকার দিয়ে উঠল|’ আ মোলো ! একলা একটা মেয়েমানুষ ভিজে পান্তাভাত হয়ে গেল তার হুঁশ নেই, উনি নাম জিজ্ঞেস করতে লেগেছেন!বলি, জেরা করবে না দোর খুলবে? অতিথিকে দাঁড় করিয়ে রাখো, এ কেমনধারা ভদ্রতা তোমাদের বাপু?’

সে গলার দাপটে খানিকটা ভেবড়ে গিয়েই বোধহয়, চৈতসিং দারোয়ান দরজার খিলটা খুলে ফেলল| সকলে অবাক হয়ে দেখল, বাইরে ছোটখাট চেহারার একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, কাঁধে একটা ঝোলা, মাথায় টোকা, গা বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে| পিছনে একটি নিরীহ খচ্চর চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভিজছে|

খানিকক্ষণ কারো মুখে কথা সরল না| রানী সবার আগে সামলে নিয়ে শুধোলেন, ‘কে বাছা তুমি, এমন ঝড়ের রাতে পথে বেরিয়েছ?’
মেয়েটা বোধহয় কটকট করে কথা শোনানোর জন্যেই তৈরি ছিল, আচমকা এমন মিষ্টি কথায় একেবারে ভ্যা করে কেঁদে ফেলে বলল, ‘ বড় বিপদে পড়ে আপনাদের কাছে এলাম| বড় অসময়ে এলাম, অপরাধ নেবেন না মা গো|’

রানী দেখলেন, জলে ভিজে মেয়েটা হি হি করে কাঁপছে, এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে জ্বরে পড়বে, নিমুনিয়া হওয়াও আশ্চর্য নয়| তিনি ডাকলেন, ‘ ওসব পরে হবে, আগে তুমি ঘরে এসো দেখি|ইস, ভিজে একেবারে জল হয়ে গেছ যে – আগে শুকনো জামাকাপড় পর, কিছু মুখে দাও, তারপর তোমার সব কথা শুনব|গোপেশ্বর, যা বাবা খচ্চরটাকে আস্তাবলে নিয়ে গিয়ে চাট্টি ঘাসজল দে|’ বলে তিনি তাঁর মহলের দিকে পা বাড়াতেই, তাঁর খাস দাসী গোলাপী আর থাকতে না পেরে বলে ফেলল, ‘দোষ নিও না মা, মেয়েটাকে যে ঘরে তুলছ, কোত্থেকে না কোত্থেকে এসেছে কে জানে! একটা বিপদ হতে কতক্ষণ ! তার চেয়ে বলি কি মা, আজকের রাতটা বরং মন্দিরের চাতালে শুয়ে থাকুক, ছাদটাদ আছে, গায়ে জলও লাগবে না, কাল সকালে ফয়সালা হবে’খন|’ রানী তাকে ধমক দেওয়ার আগেই মেয়েটা একেবারে ফুঁসে উঠে বলল, ‘ইল্লি আর কি!! চাতালে শোবে ! জানিস আমি রাজার মেয়ে ??’

যেই না বলা, বামুনদিদি, বাসনমাজুনি মোক্ষদা, মানদামাসি, পানসাজুনি বিন্তির মা, সকলে হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ল|ওলো দেখ দেখ, বলে কিনা রাজকন্যে ! কালে কালে কতই হল, আরশোলারও পাখা গজাল ! তা বাছা, রংখানা তো কেলে কাঠের মতন, সরময়দার বদলে কি আলকাতরা মেখেছিলে? আবার এসেছে খচ্চরে চড়ে! হো হো, ছ্যা ছ্যা, হি হি হি! হাসি আর থামতে চায় না| তাদের অবশ্য দোষ দেওয়াও যায় না| মেয়েটার রং এমন আহামরি কিছু নয়, পায়ের জুতোয় একপুরু কাদা, চুল চুড়ো করে বাঁধা, গলায় একখানি পদ্মবীজের মালা, হাত খালি| যা পরে আছে তার চেয়ে বামুনদির শাড়িটাও ভালো|

মেয়েটা এবারে কোমরে হাত দিয়ে রুখে দাঁড়াল| ‘তা হ্যা গো ভালোমানুষের বাছারা, কেমন বড় বাড়িতে কাজ কর শুনি? শিক্ষে সহবত কাকে বলে শেখ নি? আর আপনাকেও বলি বাপু রাজামশায়, কুড়ি বছর আগে যে আপনার প্রাণটা রক্ষে করল, জংলি ভূত বলে তাকে একেবারে ভুলে মেরে দিলেন? সাধে আমি আসতে চাই নি! বাবা নেহাত অনেক করে বলল, তাই - আহা, বুড়ো মানুষটা বিছানাতেই পড়ে আছে, কোনদিন চোখ বুজবে আর কাকা আমাদের দূর দূর করে তাড়াবে নয়ত মেরে পুঁতে দেবে| তাই তো বাবা বলল, আপনি নাকি বাবার খুব চেনা, আপনাকে এসে সব জানাতে, তা হলেই নাকি আপনি লোকলস্কর নিয়ে এসে সকলকে সিধে করে দেবেন?
তাই না আমি এত দূর থেকে এত পথ ঠেঙিয়ে আপনার কাছে এলুম! উঃ, দুদিন ধরে না নাওয়া না খাওয়া, শরীরে আমার আর কিছু নেই গো!’ ধপাস করে সে আবার মেঝের উপরে বসে পড়ল|

রাজামশায়ের মাথায় তখন ঝড় বইছে| কি বলছে এই মেয়ে? জংলি ভূত – প্রাণ বাঁচানো, তবে কি – তবে কি – কিন্তু তাই যদি হয়, তবে এতদিন এ কথা তিনি ভুলে থাকলেন কি করে? ধরা ধরা গলায় তিনি বলে উঠলেন – ‘ তুমি মংলুর মেয়ে?’ মেয়েটা ময়লা কাপড়ের খুঁটে নাক মুছে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘তবে?’

রাজামশায়ের শরীর থরথর করে কাঁপছিল, অনেক দিনের পুরনো কথা মনে পড়ছিল| তখন তিনি যুবরাজ, সিংহাসনে তাঁর বাপ, বুড়ো রাজা বসে| শিকারের প্রচন্ড নেশা ছিল তাঁর, মাঝেমাঝেই দলবল জুটিয়ে বেরিয়ে পড়তেন| একদিন একটা বিরাট বনবরাকে তাড়া করতে করতে গভীর বনে ঢুকে পড়েন| গোঁ ধরে জানোয়ারটার পিছনে ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন, সঙ্গের লোকজন কখন পিছিয়ে পড়েছে খেয়াল করেন নি| যখন খেয়াল হল, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয় হয়, ঘন বনের মধ্যে তিনি একা| জন্তুটাকে দেখা যাচ্ছিল না| ঘোড়া থেকে নেমে চারপাশ দেখতে গিয়েই বিপত্তি, কোথায় ছিল বরাটা, এক ঢুসোয় তাঁকে মাটিতে ফেলে কাঁধে সামনের দাঁত বিঁধিয়ে দিল| হাতের বল্লমটা গেঁথে তিনি জানোয়ারটাকে খতম করলেন ঠিকই, কিন্তু কাঁধের জখমটা বিষিয়ে উঠল, সেই সঙ্গে জ্বর| বনের মধ্যে হোচট খেয়ে, বার বার রাস্তা হারিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, মশার কামড় খেয়ে যখন বনের বাইরে বেরোলেন, তখন তাঁর শরীর ভেঙ্গে আসছে, সন্ধে পেরিয়ে রাত নেমেছে| চাঁদের আলোয় চারপাশ দেখে বুঝলেন, একটা গ্রামে এসে পড়েছেন, ছোট ছোট মাটির বাড়ি, খড়ের চাল, দেওয়ালে লতাপাতা আঁকা| দূরে কোথাও মাদল বাজছে| তাঁর আর কিছু বোঝার শক্তি ছিল না, একটা ঘরের দাওয়ায় উঠে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন|

আবছা জ্ঞান ফিরতে দেখলেন, তিনি একটা নিচু খাটিয়ায় শুয়ে, গায়ে প্রচন্ড ব্যথা| সামনে ছোট্ট জানালা দিয়ে রোদ আসছে, আর একটা কানের-পাশে-ফুল-গোঁজা ব্যাকুল মুখ খাটের পাশে বসে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে|শ্রান্তিতে তিনি আবার চোখ বুজলেন| পরের বার ঘুম ভাঙতে বুঝলেন, কাঁধে একটা ফেট্টি বাঁধা, শরীর দুর্বল কিন্তু গায়ের ব্যথাটা নেই| চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, মাটির দেওয়াল, ঘর পরিষ্কার করে নিকোনো, একপাশে একটা কুঁজো| উঠে বসতে যাবেন, দরজার ঝাঁপ ঠেলে একটি কালোকুলো মেয়ে উঁকি দিয়ে তাঁকে এক ঝলক দেখেই  এক গাল হেসে কোথায় যেন দৌড়ে পালাল| কিছুক্ষণ পরে হাতে একটা ঘটি নিয়ে ফিরে এল সে, তার পিছু পিছু এক জোয়ান, তেলচকচকে গা, হাতে পায়ে পেশির ঢেউ খেলছে,একটা লাল ধুতি মালকোঁচা মেরে পরা, ঝুঁটি করে বাঁধা চুল| এক গাল হেসে সে শুধোল, ‘কেমন আছিস?’ হেসে ঘাড় নাড়তে সে বিছানার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, ‘তু রাজা বটিস? ঘোড়া চড়িস? যুদ্ধু করিস?’ সেই মংলু সর্দারের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা|

তিনি যে রাজা নন, যুবরাজ, সেটা বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে| অনেকক্ষণ বোঝানোর পর মাথা নেড়ে মংলু বলেছিল, ‘উ, তু ছোট রাজা বটিস?’
মংলু গ্রামের সর্দার, আশপাশের পাঁচখানা গ্রামের লোকে তাকে মানে|যেদিন তিনি তাদের গ্রামে এসে পড়েন সেদিন তাদের পরব ছিল| নাচগান সেরে অনেক রাতে ফিরে তাঁকে দাওয়ায় পড়ে থাকতে দেখে সে ঘরে তুলে আনে| যে কয়েক দিন তিনি অজ্ঞান হয়ে ছিলেন, মংলু আর তার বউ তাঁর সেবা করে, রাত জেগে ওষুধবিষুধ লাগায়, তাঁকে বাঁচিয়ে তোলে| তাঁর জ্ঞান ফিরে আসার পরেও কয়েকদিন বেশি হাঁটাহাঁটি করার ক্ষমতা ছিল না তাঁর, সকাল বিকেল দাওয়ায় চাটাই পেতে বসতেন, মংলু তাঁকে গ্রামের হালহদিশ শুনাত| তার ভারী ইচ্ছে ছিল, ছোট রাজা তাদের গ্রামে থেকে যান|’আজকাল সবাই শহরে চলে যায় রে ছোট রাজা, আমাদের সাথে আর কেউ থাকে না|’

ফিরে আসার সময়ে মংলু তাঁর ঝোলা ভরে দিয়েছিল চাকভাঙ্গা মধু, পথে খেতে দিয়েছিল ঘরে বানানো চালের পিঠে|  তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমি তো কিছু নিয়ে আসিনি, এত করলে তোমরা আমার, বলো কি পাঠাব তোমার জন্যে? তোমায় সাহায্য করতে পারলে আমার ভালো লাগবে|’ সাধারণতঃ রাজারাজড়ার কাছে সকলে সোনাদানা, জমিজমা চায়, সেটা ভেবেই তিনি কথাটা বলেছিলেন| মংলু সে সবের ধার দিয়েও গেল না, বরং বলল, ‘ইখানে পাকা রাস্তা নাই, বর্ষায় জল হয়, সাপকাটিতে লোক মরে| একটো রাস্তা বানিয়ে দিস রে| আর যিখান-সিখান থেকে জল খেয়ে অসুখ হয়, ছেল্যারা মরে, কুয়া কাটিয়ে দিস একটো|আর তু আবার আসিস, তুকে ভালো লেগেছে মোর|’

রাজধানীতে সবাই ভেবেছিল যুবরাজ বাঘের পেটে গেছেন, তিনি ফিরে আসতে উৎসব লেগে যায় আর কি! বুড়ো রাজা শয্যা নিয়েছিলেন, ছেলের মুখে সব শুনে সাতদিনের মধ্যে লোকজন পাঠিয়ে গ্রামের রাস্তা বাঁধিয়ে দেন, বড় বড় কুয়ো কাটান অনেকগুলো| শুধু তাই নয়, গ্রামে পাঠশালা খুলে দেন, ওষুধবিষুধ ডাক্তারবদ্যিও পাঠান|

তার পর থেকে অনেকবার ভেবেছেন মংলুর গ্রামে যাবেন, কিন্তু রাজকাজের পাকেচক্রে এত বছর সেটা হয়ে ওঠে নি| সেই মংলুর মেয়ে এসেছে এতদিন পরে!

তাঁর বুকের মধ্যে ঝড় বইছিল, তিনি শুধু ভারী গলায় রানীকে বললেন, ‘ মেয়েটা অনেক দূর থেকে এসেছে, কিছু খাবারদাবারের ব্যবস্থা করে দাও| আর শুকনো কিছু পরতে দাও, যা ভিজেছে, অসুখ করবে|’ রানী তাঁর মুখ দেখে বুঝেছিলেন তাঁর ভেতরে কিছু একটা চলছে| তিনি বুদ্ধিমতী, খোঁচাখুঁচি করলেন না, মেয়েটাকে নিয়ে নিজের মহলে পা বাড়ালেন| তাঁর মাথায় তখন অন্য একটা মতলব ঘোরাফেরা করছে| আড়চোখে তিনি দেখে ফেলেছেন, মেয়েটার কপালে যেখানে দু-এক কুচি চুল লেপ্টে রয়েছে, কান বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে, গুণধর ছেলে তাঁর সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে, যেমন তাকায় পুরুষ তার প্রিয়তমা নারীটির দিকে| যেতে যেতে মনে মনে একচোট হেসে নিলেন তিনি, পথে এসো বাছাধন! কোনো মেয়েই পছন্দ হয় না, কেমন? রোসো, তোমায় দেখাছি মজা!

হাতমুখ ধুয়ে, কাপড়চোপড় পালটে, চুল আঁচড়ে মেয়েটা যখন এসে খেতে বসল, তখন বামুনদিদির দলও ফিসফিস করে বলতে বাধ্য হল, যতটা হ্যাক থু করা হয়েছে ততটা নয়| রংখানা চাপা বটে, কিন্তু নাক মুখ চোখা চোখা, টানা টানা ঝকঝকে চোখ, খাটিয়ে-পিটিয়ে হাত-পা| যখন ঝগড়া করে তখন অন্য কথা, এমনিতে গলার আওয়াজটি মিঠে|

খিচুড়ি শেষ হয়ে গেছিল, চিঁড়ে দই কলা দিয়ে মেয়েটাকে খেতে দেওয়া হল| টুকটাক কথা বলতে বলতে হাত চেটে চেটে খেল, মাঝে একবার ফিক করে হেসে বলল, ‘ বলিহারি যাই আপনাদের সব লোকজনকে|ঘর পরিষ্কার করতে এমন ব্যস্ত যে ভাতে-ভাত করার সময়ও পেল না?’ রানী কাছে বসে খাওয়াতে খাওয়াতে টের পেলেন, ছেলে খাবার ঘরের আশেপাশে অস্থির হয়ে ঘুরঘুর করছে| মেয়েটা সেসবে আমলই দিল না|
মেয়েটা খাওয়া শেষ করে সেখানেই ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়েছে| তাকে কোথায় শুতে দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে রানীর মনে হল, এই মেয়েটার সঙ্গে ছেলের বিয়ে হতে পারে কি? রাজার মুখ দেখে, কথা শুনে তিনি বুঝেছেন, এ মেয়ের বাবা নিশ্চয় তাঁর বিশেষ পরিচিত| ছেলের যে পছন্দ, সে তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়| এই দুর্যোগের রাতে যে অতটা পথ উজিয়ে আসতে পারে, তার সাহসটা ফেলে দেওয়ার মতও নয়| খাওয়ার সময় কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে লেখাপড়া করেছে, হাত-পা দেখে মনে হয় পরিশ্রমীও বটে| আর কি চাই? শুধু একটা জায়গাতেই আটকাচ্ছে| এ মেয়ে সেই ‘সত্যি রাজকন্যে’ তো? একবার পরীক্ষা করে দেখবেন? ক্ষতি কি? দেখাই যাক না|

রানীর হুকুমে তাঁর মহলেই একটা ঘর খুলে দেওয়া হল| রানীমার হুকুমে গোলাপী, সোনালিরা গজগজ করতে করতে খাটের উপর চাপাল কুড়িখানা গদি আর গোটা পনেরো তোষক|তার উপর ঢাকা পড়ল নরম চাদর, কুঁচি-দেওয়া ওয়াড় পরানো তুলোর বালিশ, পরানো হল মিহি জালের মশারি| সে সবের নীচে রানী নিজের হাতে রাখলেন একটি ছোট্ট মটরদানা|

সবাই বেদম ক্লান্ত ছিল, সেদিন রাতে ঘুম হল জব্বর| সকলে যখন বিছানা ছাড়ল, তখন বেশ বেলা হয়েছে, মেঘ কেটে গিয়ে রোদ উঠেছে| মুখ ধুয়ে চায়ের কাপ নিয়ে সকলে খাবার ঘরে গুছিয়ে বসেছে, রাজামশায় রাজসভায় যাবেন বলে কোমরে বেল্ট আঁটছেন, রানী মানদাকে বলে দিচ্ছেন কি কুটনো কুটতে হবে, এমন সময়ে মেয়েটা চোখ রগড়াতে রগড়াতে এসে দরজায় দাঁড়াল|
রানী তাকে ডাকলেন, ‘ এসো| বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?’ সে এসে একটা চেয়ার টেনে গাল ফুলিয়ে বসল| তার চুল উস্কোখুস্কো, চোখের নীচে কালি|
‘কাল রাতে ঘুম হয়েছিল? তুমি কি চা খাও, না দুধ দিতে বলব?’

প্রশ্নটুকু করার যা অপেক্ষা, সঙ্গে সঙ্গে তড়বড় করে মেয়েটা বলতে লাগল, ‘ ঘুম হয়েছে না ছাই ! সারারাত খালি এপাশ আর ওপাশ! মাথাটা ধরে গেছে, মাগো!’
‘তা গদি-তোশকে শোয়ার অভ্যেস না থাকলে কি আর ঘুম আসে বাছা, কুকুরের পেটে ঘি বই তো নয় !’ ফুট কাটল মানদা|

‘তাই নাকি? তা যাও না, ও বিছানায় একবার শুয়ে দেখ না! সারা রাত ধরে পিঠের নিচে কি যেন ফুটেছে, বাপরে! এই নাকি রাজার বাড়ির বিছানা!রাম রাম!’
মানদা নাক কুঁচকোল বটে, কিন্তু রানীমা মনে মনে ভারী খুশি হয়ে উঠলেন| যাক নিশ্চিন্তি, এই মেয়ে একদম খাঁটি রাজকন্যে| অন্য কেউ হলে কেউ ওই মটরদানার কথা বুঝতেই পারত না|

এবার শিগগির রাজামশায়কে দিয়ে ওর বাড়িতে খবর পাঠাতে হবে| ছেলের অমত হবে না তিনি জানেন, যদি বেগড়বাই করেও, তিনি কষে কানমলা দেবেন| মেয়েটাকেও জিজ্ঞেস করতে হবে বই কি| আপত্তি করবে কি? মনে হয় না, বাকিটা নাহয় ছেলে বুঝে নেবে, এমনিতেই তো চোখে হারাচ্ছে! মেয়েটা একটু খরখরি টরটরি আছে, তা হোক| তাঁর গোঁয়ারগোবিন্দ ছেলের জন্যে এমনি একটি মেয়েরই ভা-রি দরকার ছিল|

Story by +anwesha sengupta for Jhaalmuri Barsha 2015



Jhaalmuri 

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...