‘স্যাংগুইস্টিক ভিউ রে দাদা
ল্যাদারিং কিস্কু
ডিলুক্স দ্য ফক্স অ্যান্ড
ক্যাট ক্যাট ক্যাট।‘---
না, সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’-এর এযাবৎ অপ্রকাশিত কোনো অংশ নয়। ওপরের এই চারটে লাইন আমার বাবার তৈরি। ভূভারতে, আর শুধু ভারত-ই বা কেন, এই বিশাল বিশ্বের কেউ এই চার লাইনের মানে জানে না। এমনকী, বাবা নিজেও না। কারণ, এর কোনো মানেই হয় না। এ একেবারে আবোলতাবোল, যাকে বলে যাচ্ছেতাই। তবু এর মধ্যে কী আছে জানি না, আমার জাঠতুতো, খুড়তুতো, মামাতো, পিসতুতো ভাইবোন, দাদাদিদি, এমনকী ভাগনে ভাগনিরা যারা এই লাইনগুলো ছোটোবেলা থেকে আমার বাবার মুখে শুনে বড়ো হয়েছে তারা খুব উপভোগ করেছে।
বাবার সম্পর্কে লিখতে বসলে প্রথমেই যে লাইনটা টুক করে সাদা পাতার মাথাটা দখল করে, সেটা হল, বাবা আমার গায়ে কোনোদিন হাত তোলেনি। বরং, উলটো ঘটনাটাই ঘটেছে। বরাবর, পড়া তৈরি না হলে কিংবা কোনো বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেললে তক্ষুনি আশ্রয় নিয়েছি বাবার ওই ‘ব্যায়াম করা’ চওড়া পিঠের আড়ালে।
বাবাকে নিয়ে লেখা মোটেও সহজ কথা নয়। তার কারণ, আমার বাবা ভদ্রলোক এক জীবন্ত অমনিবাস। আর তাই, সেই অমনিবাসের রিভিউ লিখতে গেলে আগের কথা পরে যাবে, পরের কথা আগে চলে আসবেই। অর্থাৎ, এলোমেলো হবে। হবেই। তা হোক। দশে আট পাওয়ার চিন্তা তো আর নেই!
স্মরণের নৌকো বেয়ে প্রথম যে কথাটা মনে পড়ে, সেটা হল ‘ধার করা’ বা ‘হাতে রাখা’ বিয়োগ। অর্থাৎ, যে বিয়োগ অঙ্কের দোতলার এককের ঘরে ‘০’ থাকলে, একতলার এককের ঘরে ‘১’ থেকে ‘৯’-এর মধ্যে যেকোনো অঙ্ক—এ-রকম। এই ‘ধার করা’ বিয়োগ প্রথম শিখি বাবার কাছে। বাবা আমার প্রথম শিক্ষক।
বাবার সঙ্গে কোনোদিন চিড়িয়াখানা বা সার্কাসে গেছি বলে মনে পড়ে না। টুকটাক কাছেপিঠে বা কলকাতায় মামার বাড়ি যাবার সময় ‘বাজাজ’ স্কুটারটার সামনের সিটে বাবার সামনে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে বসতাম। বাবা মাঝে মাঝেই বলত, ‘ওহ, কবে যে বড়ো হবি। বাঁকের মুখে হ্যান্ডল ঘোরাতে খুব অসুবিধে হয়।‘ একদিন আমি বড়ো হয়ে গেলাম। স্কুটারের পেছনের সিটে বসে নিজেকে কেমন ‘পূর্ণাঙ্গ’ বলে মনে হল।
১৯৯২ সালের সেই দিনটার কথা মাঝে মাঝেই বেশ মনে ভেসে ওঠে। সেই শীত সন্ধেয় বাড়ি ফিরে বাবা বলল, আমরা কাল ইডেন গার্ডেনে ক্রিকেট খেলা দেখতে যাব। সেজো জেঠু দুটো টিকিট দিয়েছে। আমি তখন ক্লাস সেভেন। সেই রাতে আমার ভালো করে ঘুমই হল না। উত্তেজনায়, অজানা আনন্দে। বাবা মাকে বলল, ‘কাল সকালে লুচি, আলুরদম।‘
অনেক ভোরে ঘুম ভাঙল। ঠিক যেমন ষাণ্মাসিক আর বার্ষিক পরীক্ষার দিনগুলোতে ভাঙত। সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ইডেনে পৌঁছে গেট দিয়ে ঢুকে বিস্ময়ের ঘোর কাটতে একটু সময় লাগল। এতদিন শুনে আসা সেই সবুজ গালচে চোখের সামনে। সেখানে ম্যাচ শুরুর আগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে দীর্ঘদিনের নির্বাসন থেকে মুক্তি পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা দল। অধিনায়ক ক্লাইভ রাইস, গ্যারি কার্স্টেন, আগুনে অ্যালান ডোনাল্ড। প্রস্তুত হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট দল। প্রস্তুত হচ্ছে শচীন তেন্ডুলকর।
আমাদের ‘এফ’ ব্লক। ক্লাব হাউসের ঠিক উলটো দিকে নাকবরাবর। সিট নম্বর দেখে বসতে গিয়ে আমার ইডেন-অভিজ্ঞ বাবা বলল, এখানে রোদ আসবে, ওপরের দিকে চ। চলে গেলাম শেডের তলায়। খেলা শুরু হল। আমার প্রথম ‘ছায়ার ইডেন’। আমার প্রথম ‘মায়ার ইডেন’। খেলা একটু এগোনোর পরেই এক ভদ্রলোক তাঁর সিট খুঁজতে খুঁজতে চলে এলেন ওপরের দিকে। খেলা চলছে পুরোদমে। চারপাশ থেকে বেশ কয়েকজন সমস্বরে বলে উঠল, ‘দাদা, বসে পড়ুন, বসে পড়ুন, যেখানে ফাঁকা পাচ্ছেন, বসে পড়ুন।‘ কাণ্ড দেখে বাবার দিকে তাকাতে বাবা ইশারায় বলল খেলা দেখতে। আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম, কোন ফাঁকে আমার মধ্যে অনেকটা ইডেন ঢুকে গেছে। সেটা ছিল দিনের ম্যাচ। দিনের ইডেনের গায়ে যখন একটু একটু করে গোধূলির গন্ধ লাগতে শুরু করেছে সেই সময়ে ভারতের জয় আর শচীনের এক বিধ্বংসী ইনিংসের সাক্ষী থেকে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম দুজনে।
ক্লাস সেভেন থেকে অঙ্ক আর ফিজিকাল সায়েন্সের ডিপার্টমেন্ট চলে গেল বাবার তত্ত্বাবধানে। সে এক যুদ্ধ শুরু। প্লাসে প্লাসে প্লাস, প্লাসে মাইনাসে মাইনাস। বি ফর শুধুই ব্যাট নয়, বি মানে ‘বোরন’-ও বটে। শুধুই কি হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, চিহ্ন, সংকেত, যোজ্যতা? উপপাদ্য ২৩ আর ২৪ আছে না? সঙ্গে আছে দুনিয়ার ‘এক্সট্রা’। আছে সেই লাল খাতা, যাতে লিখে রাখা আছে পরীক্ষার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু মালমশলা, পরীক্ষার আগের রাতে যেগুলোয় চকিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া আবশ্যক। এই নিয়মের কোনো নড়চড় হবার জো নেই। কারণ মাস্টারমশাই হিসেবে বাবা যেমন অক্লান্ত, তেমন কড়া। মাধ্যমিক পরীক্ষার বছরের সেই সন্ধেগুলোর কথা কি সহজে ভোলা যায়? সারাদিন স্কুলে উদ্দাম হইহুল্লোড়ের পরে বাড়ি ফিরে সন্ধেবেলা যখন ভৌতবিজ্ঞান বা অঙ্কের বই খুলে বাবার সামনে বসে ঢুলছি, বাবা এক হাতে কাঠের হাতুড়িটা নিয়ে টেবিলের ওপর ‘অর্ডার, অর্ডার’ স্টাইলে ঠক ঠক করে ঠুকছে আর সেই আওয়াজে আমার চটকা ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। তখনও আমার নিজস্ব আলাদা ঘর হয়নি। বাবা, মা আর আমি এক খাটে শুই। আমি আর মা শুয়ে পড়েছি। ক্লান্ত শরীরে ঘুমও খিল খুলে ভেতরে ঢুকতে চাইছে। এমন সময় সব দরজা-টরজা বন্ধ করে বাবা ঘরে ঢুকল। ঢুকেই শুরু করল কথা বলতে। কথা মানে, কোনো জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার একেবারেই নয়। যত অর্থহীন, ভুরভুরে সোডা ওয়াটারের মতো হাসি জাগানো কথার ফোয়ারা। সেই রাতদুপুরে, ঘুমের বেলায়। মুহূর্তে ঘুমের সলিলসমাধি।
আমাদের বাড়িতে টেবিল টেনিস খেলা চালু হয়েছিল। সেই খেলার মূল কুশীলব বাবা আর আমি। কখনো-সখনো বাবার দু-একজন ছাত্র। টেবিল টেনিস ব্যাট আর পিংপং বল বাড়িতে কেনাই ছিল। বড়ো রান্নাঘরে খাবার টেবিলটা হয়ে গেল টেবিল টেনিস বোর্ড। আর নেট? বাড়িতে অজস্র বইয়ের ভান্ডার থেকে একটু অসুস্থ আর পাতলা গোটা চারেক বই টেবিলের ওপর আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে হয়ে গেল জালহীন নেট। এরপর শুধু লাভ ওয়ান, লাভ টু, ওয়ান অল। গণ্ডগোলটা হয়েছিল সেই একদিন। গ্যাসে দুধ ফুটছে। পায়েস হবে। টপ স্পিন করানোর লক্ষ্যে একজন খেলোয়াড় কায়দা করে বলের গায়ে ব্যাট ছোঁয়াল। বল খুব সুন্দরভাবে পাখির মতো উড়তে উড়তে গিয়ে পড়ল দুধের বাটির মধ্যে এবং পড়েই সমুদ্রের মধ্যে একলা এক জেলেডিঙির মতো একবার এদিক, একবার ওদিক। ঠিক সেই মুহূর্তেই বারান্দার ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল, ‘দুধটা ফুটল নাকি দেখ তো রে?’ মুহূর্তের মধ্যে গ্যাসের পাশে রাখা হাতাটা তুলে নিয়ে দুধের সাগর থেকে পিংপং পাশের সিঙ্কে, কলের তলায়। তারপর বাসন মোছার কাপড়ে মুছে নিয়ে আবার ‘লাভ টু, টু ওয়ান, টু অল’। দুধ তখনও গ্যাসের ওপর নিজের মতো ফুটছে।
বাবা সচরাচর রিকশায় চড়তে চায় না। হেঁটে যাবে, তবু রিকশায় চড়বে না। খুব নিরুপায় হলে, রিকশায় পা দেওয়ার আগে এক অদ্ভুত দরাদরি করবে। বলবে, ‘দশ টাকায় (ক্ষেত্রবিশেষে, পনেরো বা কুড়ি) তুমি কতদূর যাবে, ভাই? যেখানে গিয়ে তোমার “দশ টাকা” শেষ হবে, বলবে। আমি নেমে যাব। বাকিটা হেঁটেই চলে যাব।‘ এ-রকম অদ্ভুত কথা শুনে সাধারণত বেশিরভাগ রিকশাওলাই বলে, ‘আচ্ছা, চলুন।‘ বলে, পুরোটাই ওই ভাড়ায় পৌঁছে দেয়। আর কারো ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার হয় কি না জানি না, তবে আমার বাবাকে প্রায়ই দেখি দুটো জিনিস প্রায় রোজ নিয়ম করে একবার হারিয়ে ফেলে আর তারপর অনেকক্ষণ ধরে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। আর কিছুতেই খুঁজে না পেলে সারা বাড়ি মাথায় করে। সেই মহার্ঘ জিনিস দুটো হল চশমার খাপ আর পেন। পেন খুঁজে না পেলে অস্থিরতার পরিমাণ খুব বেশি হয়। তার কারণ, সব পেন বাবার, যাকে বলে, ঠিক ‘সুট’ করে না। চিত হয়ে শুয়ে বুকের ওপর খবরের কাগজ রেখে সাবলীলভাবে যে পেন দিয়ে ‘শব্দছক’ করা যায়, সেই পেনই বাবার সবচেয়ে আদরের। তা সে, নীল, লাল, কালো, সাদা, সবুজ যে কালিরই হোক না কেন। আর দেশি, বিদেশি, আঞ্চলিক, পাড়াতুতো যে কোম্পানিরই হোক না কেন।
ভূগোল বইয়ে ছোটোবেলায় পড়েছিলাম, ভারতের বা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্য বিভিন্ন। বাবার প্রধান পানীয় হল ‘চা’। সকাল পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটায় (শীতকালে ছ-টা, সাড়ে ছ-টা) ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাত সাড়ে এগারোটা-বারোটায় শুতে যাবার আগে পর্যন্ত সারাদিনে বিভিন্ন সময়ে ‘স্লট’ অনুযায়ী বাবা চা খায়। যেমন, সকাল সাড়ে পাঁচটা, সাড়ে সাতটা, সাড়ে আটটা, দশটা, সাড়ে বারোটা—এ-রকম ভাবে দিনের শেষ চা রাত আটটা-সাড়ে আটটায়। এর মধ্যে কোনো একটা বা দুটো চা কোনোদিন বাদ পড়লে সারাক্ষণ মনটা কেমন যেন খুঁত খুঁত করতে থাকে। ‘. . .আজ একটা চা বাদ গেল! ইস!’ একদিন সকালে দেখি বাবা ক্যালকুলেটর হাতে রীতিমতো গম্ভীরভাবে কী যেন হিসেব করছে। কাছে যেতেই ইশারায় কথা বলতে বারণ করল। আমি চুপচাপ উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরে, ক্যালকুলেটর থেকে মুখ তুলে, আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি বছরে এত কাপ চা খাই।‘ বলে ক্যালকুলেটরটা আমায় দেখাল। আমি দেখলাম, ক্যালকুলেটরের স্ক্রিনে একটা বেশ বড়োসড়ো সংখ্যা। আমি কী বলব, আমার কী বলা উচিত, ঠিক করতে না পেরে আমি যতটা চুপ ছিলাম, তার থেকেও বেশি চুপ করে গেলাম। একজন মানুষ, কোন পর্যায়ের চা-প্রেমী হলে এই ধরনের হিসেবনিকেশ মাথায় আসে আমি ভেবে পেলাম না। এর পরে, অবশ্য বাবা আমায় মাসিক চা-সেবনের হিসেবটাও বুঝিয়েছিল।
বাবার উদ্ভাবিত কিছু শব্দবন্ধের মধ্যে একটা হল ‘সাকুল’। বাবার নিজস্ব অভিধান অনুযায়ী যার মানে হল ‘অদ্ভুত’। বাবাকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘তুমি একটা সাকুল।‘ কোনো জায়গার অবস্থান বাবার কাছে জানতে চাইলে বাবা সবসময় একটা অদ্ভুত উত্তর দেয়। একটু খোলসা করে বলি। যদি বাবাকে কেউ জিজ্ঞেস করে, ‘স্যাকরা পাড়াটা ঠিক কোন দিকে বলো তো?’ বাবা বলবে, ‘তাঁতিপাড়ার উত্তরদিকে।‘ ব্যস, হয়ে গেল। আর কী? সন্ধেবেলা হলে যেকোনো কাউকে পাকড়ে আগে জানতে হবে, সূর্য কোনদিকে ওঠে, ভাই? মানে, পুব দিক কোনটা? তার পর সেইমতো হিসেব করতে হবে উত্তর দিক কোনটা। তখন জানা যাবে, স্যাকরা পাড়া যেতে গেলে ঠিক কোনদিকে যেতে হবে। আমার বাবার মতো এতটা ‘দিকপ্রিয়’ মানুষ আর কেউ আছে কি না জানি না। তাই সচরাচর আমি বাবার কাছে কোনো জায়গার খোঁজ করি না। কারণ আমি জানি আমার মতো দিগভ্রান্ত খুব কমই আছে।
ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি, ‘বিশ্বনাথ’ শব্দটা কানে গেলেই বাবা ডান হাতের তর্জনী আর তার পাশের আঙুলগুলো জড়ো করে কপালে ঠেকিয়েই বুকে ঠেকায়। মানে, নমস্কার করে আর কি। কিন্তু কেন যে ওই বিশেষ একটা শব্দ শুনলে এ-রকম করে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। একটু বড়ো হওয়ার পর জানতে পারলাম, বিখ্যাত ক্রিকেট খেলোয়াড় গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ বাবার অন্যতম প্রিয় একজন খেলোয়াড়। বাবা তাঁকে ‘গুরু’ মানে। তাই এ-রকম আচরণ করে।
১৩ মার্চ দিনটা এলেই ঘুম ভেঙে সেদিনের কথা মনে পড়ে। সেদিন মানে, ১৯৯৬ সালের ১৩ মার্চ। ইডেনে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে দিন-রাতের ম্যাচে মুখোমুখি মহম্মদ আজহারউদ্দিনের ভারত আর অর্জুন রণতুঙ্গার শ্রীলঙ্কা। আমাদের ছিল ‘জে’ ব্লক। পিচটাকে আমরা দেখছিলাম একটু কোনাচে ভাবে। আমাদের আশেপাশে কিছু অল্পবয়সি যুবকের একটা দল ছিল। তাদের মধ্যে একজনকে আবার হুবহু অভিনেতা জ্যাকি শ্রফের মতো দেখতে। তাদের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল। প্রথম সাড়ে তিন ঘণ্টা বেশ উত্তেজনা আর হইহইয়ের মধ্যে দিয়ে কেটে গেল। বিরতির পর খেলা শুরুর খানিকক্ষণ বাদেই সমস্ত হিসেব যেন উলটে গেল। ম্যাচ একটু একটু করে ভারতের হাতছাড়া হতে শুরু করল। জেতার আশা যখন খানিকটা কমে এসেছে, হঠাৎ বাবা হাতে আলতো চাপ দিয়ে ইশারায় বলল উঠে পড়তে। কী ব্যাপার? খেলা-ফেলা না দেখে ফিরে যাব নাকি? কিন্তু কোনো প্রশ্ন না করে সিট ছেড়ে উঠে পড়লাম। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যখন স্টেডিয়ামের বাইরে আসছি, হঠাৎ মনে হল স্টেডিয়ামের ভেতরে যেন খুব গোলমাল হচ্ছে। আচমকা বেরিয়ে আসার কারণ জানতে চাইলে বাবা বলল, এর পরে বেরোতে নাকি সমস্যা হত। ঘড়িতে তখন সাড়ে ন-টা বেজে গেছে। রাস্তায় বাসের দেখা নেই। হাতে গোনা যে দু-একটা বাস চোখে পড়ছে, হয় তাদের গন্তব্য আমাদের থেকে আলাদা, নয়তো পা রাখার জায়গা নেই, এত ভিড়। অগত্যা হাঁটতে শুরু করলাম দুজনে। পরাজয়ের ক্লান্তি মনে নিয়ে ইডেন থেকে হাঁটতে হাঁটতে যখন রাত সাড়ে দশটা পৌনে এগারোটায় হাওড়া ময়দানে এসে পৌঁছোলাম তখন ময়দানে অনিমেষ অন্ধকার রাত জাগতে শুরু করেছে। মধ্য-মার্চের তীব্র গরমে আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ। কোনোরকমে একটা আধখানা দরজা খোলা দোকান দেখতে পেয়ে একটু জল খেয়ে আবার হেঁটে বাড়ি ফিরি। ছাদে তখন মা, কাকিমা, মামা, দাদাদের উদগ্রীব মুখ। কারণ স্টেডিয়ামে আগুন জ্বলেছে।
একদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর বাবার দিকে তাকিয়ে খুব জোর হেসে ফেলি। তার কারণ বাবার পোশাক। দেখি, পাজামার ওপর একটা লুঙ্গি পরেছে। আর ফুল হাতা পাঞ্জাবির ওপরে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। কিছুই বুঝতে না পেরে যখন বোকার মতো তাকিয়ে আছি তখন আমার ‘সিস্টেমেটিক’ বাবা জানাল যে, গত কয়েক দিন রাতে হঠাৎ খুব শীত করছিল। তাই আগের দিন রাত থেকে বাবা ঘুমোতে যাওয়ার আগে মাথার পাশে একটা বাড়তি গেঞ্জি, লুঙ্গি আর যা যা সম্ভব নিয়ে শুচ্ছে। যখন যেমন শীত করবে একটা একটা করে পরে ফেলবে, এই হল রাত্রিকালীন পরিকল্পনা।
রাত্তিরে ঘুমের মধ্যে আমরা অনেকেই স্বপ্ন দেখি। আবার সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর অনেক সময় সেই স্বপ্নের বিষয়বস্তু মনে থাকে না। এই ব্যাপারটাতেও আমার বাবার একটা অদ্ভুত বিশেষত্ব আছে এবং আমার ধারণা সেটা আর কারো নেই। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে দেখতে কোনো কারণে ঘুম ভেঙে গেলে, একটু জল-টল খেয়ে আবার ঘুমোতে শুরু করার পরে আমার বাবা আগের সেই অসমাপ্ত স্বপ্নটা শেষ দেখার পর থেকে আবার দেখতে শুরু করতে পারে। কোন কায়দায় এ-রকম ঘটনা ঘটতে পারে সেটা বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু বাবা বলতে পারেনি।
একদিন সন্ধেবেলা খাটের একধারে বসে মা কাজ করছে। আমার পড়ার টেবিলে বসে আমি পড়ছি। মাথা ধরেছে বলে বাবা খাটের একপাশে চোখ বুজে শুয়ে। হঠাৎ বলল, ‘আলোটা চোখে খুব লাগছে। নেবানোও তো যাবে না, তোমরা কাজ করছ। আমি তবে একটু গান্ধারি হই।‘ এ-রকম একটা অদ্ভুত বাক্য শুনে আমি পড়া ফেলে, মা কাজ ফেলে অবাক চোখে তাকাই। দেখি, বাবা স্যান্ডো গেঞ্জিটা সরু করে পাকিয়ে চোখের ওপর ফেলে রেখেছে। ব্যস, আর চোখে কোনো আলো লাগছে না। সেই প্রথম আমাদের বাড়িতে গান্ধারির প্রবেশ। তার পর থেকে মাঝে মাঝেই এখনও তাঁকে আমাদের বাড়িতে দেখা যায়।
আরও একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আছে আমার বাবার। আমি বলি, বাবার সিগনেচার। সেটা হল, বেশির ভাগ সময়েই বাবা সবুজ জলের বোতলটার ঢাকনা নীল বোতলে বা নীল বোতলের ঢাকনা হলুদ বোতলে পরায়। এর পেছনে কোনোরকম বর্ণান্ধতার যুক্তি নেই, সেটা আমরা একবার নয়, একাধিকবার পরীক্ষা করে দেখেছি। আসলে, এটাও বাবার একটা সিগনেচার। বিচিত্র কম্বিনেশনের বোতল চোখে পড়লেই আমরা মুহূর্তে বুঝে যাই কার কাজ।
এই সব কিছু, এই সমস্তটা মিলিয়েই আমার শ্রীযুক্ত বাবা। তাই আমাদের পরিবারেও, বিশেষত আমার জাঠতুতো, খুড়তুতো দাদা-দিদি, ভাই-বোন, ভাগনে-ভাগনির মধ্যে বাবার ডিম্যান্ড এত বেশি।
Story by +Anamitra Ray for Jhaalmuri Boisakhi
Read the entire e-magazine at http://www.jhaalmuricorner.com/jhaalmuriboisakhi.html
Jhaalmuri
Spread Creativity. Spread Happiness.
http://from-the-jhalmuri-corner.blogspot.in/
mail: thejhaalmurigang@gmail.com
mail: thejhaalmurigang@gmail.com