Story by +Anamitra Ray
আম পাতা জোড়া জোড়া
মারব চাবুক ছুটবে ঘোড়া
ওরে বিবি সরে দাঁড়া
আসছে আমার পাগলা ঘোড়া
পাগলা ঘোড়া খেপেছে
বন্দুক ছুঁড়ে মেরেছে
অল রাইট ভেরি গুড
মেম খায় চা-বিস্কুট।
এ হল সেই আগডুম বাগডুম বয়েসের কথা। যারা ছোটো থেকে বড়ো হয়ে বুড়ো হল, যারা ছোটো থেকে বড়ো হচ্ছে বা যাদের এখনও বড়ো হওয়া শুরু হয়নি, তাদের সবার কথা। এই ধরনের ছড়া বা কবিতায় কোনোদিন কোনো লেখক বা লেখিকার নাম লেখা ছিল না। যেটা ছিল, তা হল, শেষ পঙক্তির ডান দিকে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে একটু ছোটো হরফে, ‘প্রচলিত’। তাই আমরা এটুকু জেনে বা শিখেই ক্ষান্ত হয়েছি যে মেম বিস্কুট দিয়ে চা খেয়েছিলেন। আর আমার মতো বিস্কুট-প্রেমীরা আর একটু যোগ করে নিয়েছি নিজে নিজেই—‘বিস্কুট ছাড়া চা খেতে নেই। খাওয়া যায় না। পানসে লাগে।‘
বিস্কুট হল এক অনন্ত মহাকাব্য। এ মহাকাব্যের অনেক অধ্যায়। প্রত্যেক অধ্যায়ের পরতে পরতে রহস্য, রোমাঞ্চ। যাঁরা উচ্চারণ নিয়ে লড়াই করেন, তাঁরা ইংরেজি অভিধান খুলে বোঝানোর চেষ্টা করবেন ‘বিস্কুট’ নয়, ‘বিস্কিট’। কিন্তু, বিস্কুট আমার ভোরের স্বপ্নে, আর বিস্কিট বারান্দা পেরিয়ে রান্নাঘরের তাকের কোনায়।
থিন না মেরি? থিনও, মেরিও। বড়োরা বলবে, মেরি নয়, মারি। শিশুমন বলবে, আমার মেরিই ভালো।
একটা থিন বিস্কুট মানে অনেকটা মনঃসংযোগ। কারণ সুদর্শন চক্রের মতো ‘কিরি কিরি’ ধারওলা একটা থিন বিস্কুটের ধার বরাবর ক্লক ওয়াইজ বা অ্যান্টি ক্লক ওয়াইজ একটু একটু করে কামড়ে কামড়ে একটা নিটোল গোল রূপ দেওয়ার অক্লান্ত চেষ্টা। কখনো সাফল্য, কখনো ব্যর্থতা। তাই থিন বিস্কুটের মোহ জীবন ছাড়ে না।
খুব ছোটোবেলায় মেজোমামু বলেছিল, থিন বিস্কুট খেয়েই জল খাবি না। অম্বল হবে। এই বিশেষ তথ্যটা কোন বইয়ের পরিশিষ্টে লেখা ছিল জানি না, আজ তাই একটা বিস্কুট খেয়ে অনেকটা জল খাই।
পেটুকরাম একের পর এক উলটোপালটা খাবার খেয়ে যেদিন শয্যাশায়ী হল, দুপুরে ভাতের পাতে তার জন্য বরাদ্দ হল আলু, পেঁপে আর কাঁচকলা দিয়ে শ্যামবর্ণ ঝোল সেই প্রবল দুঃখের দিনে পেটুকরামের পাশে যে বন্ধুটি ছিল সে আর কেউ নয়, তার সাধের থিন বিস্কুট। এক বাটি শুকনো মুড়ির ভেতর থেকে লাইটহাউসের মতো মাথা তুলেছিল বিস্কুটের ছোট্ট ছোট্ট টুকরো আর মুড়ির সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে মিশে ছিল বিস্কুটের গুঁড়ো। সেই দুঃখের দিনে তাকেই পেটুকরামের মনে হয়েছিল যেন সাক্ষাৎ ‘দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর কাঁচের তাকে থরে থরে সাজানো কমলা অমৃতি।
থিন বিস্কুটের পর ক্রিম বিস্কুট। টিফিনে দু-পিস স্যান্ডউইচের পাশের ছোট্ট খোপটায় দু-জোড়া অরেঞ্জ ক্রিম বিস্কুট উঁকি দিলে মনে আনন্দের ঝড় বয়ে যায়। আর কোনোরকমে স্যান্ডউইচ গলাধঃকরণ করেই ক্রিম বিস্কুটের জোড় খুলে নিয়ে জিভ দিয়ে চেটে আগে ক্রিমের স্বাদগ্রহণ, তারপর শুকনো বিস্কুট চিবিয়েই এক ঢোঁক জল।
আর সেই প্রথম দুধের গেলাসে চায়ের লিকার মিশিয়ে খাওয়ার দিন? উত্তেজনায় হাত ফসকে বিস্কুট ডুবে যায় দুধসাগরে আর তৎক্ষণাৎ ফুলে, ফেঁপে একশা। সে আর এক উত্তেজনা।
বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চা-জীবনের সঙ্গে বিস্কুট-জীবনও অন্তরঙ্গভাবে জড়িয়ে গেছে। তাই বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যেই শুধু নয়, কাজে বেরিয়ে রাস্তায় যখন চা-তেষ্টায় প্রাণ ছটফট, তখন পথের ধারে চা-গাড়ির সামনের বেঞ্চে বসেই বিস্কুটের সারি সারি বয়ামের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আর দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চাওয়া, ‘কোনটা? ওই লম্বা, চৌকোটা, গোল বাদাম দেওয়াটা, নাকি, ওই একটা এবড়োখেবড়ো বিস্কুট সব চা-দোকানেই থাকে, সেইটা?’ মূল কথাটা হল, এক কাপ কেন, আণুবীক্ষণিক এক ভাঁড় চা খেলেও সঙ্গে চা-দোকানের একটা বিস্কুট খেতেই হবে। যারা প্রকৃত বিস্কুটপ্রেমী, তারা ডগ-বিস্কুটও সমান আনন্দে, সমান উত্তেজনায় খেয়ে থাকে। এ প্রমাণ আমার কাছে আছে।
মহাকাব্যের আর এক অধ্যায় জুড়ে আছে সেই গোল, গোল নারকোল বিস্কুট, যার ঠিক মাঝখানে খোদাই করে লেখা, ‘BILL’। সেই ‘বিল’ বিস্কুটের চিরন্তন স্বাদ আর কারো বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে মিষ্টির প্লেটের পাশে একটা কি দুটো ‘বিল’ বিস্কুট হঠাৎ আবিষ্কারের আনন্দ (যাকে ‘পুলক’ বললে ঠিক ঠিক বলা হয়) অন্য কোনো দামি, কম দামি, সাধারণ বা তুচ্ছ বিস্কুটও আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি। এই নারকোল বিস্কুট আবার ছোট্ট ছোট্ট আট আনা কয়েনের আকারেও পাওয়া যেত। তবে তা কিন্তু একটা কি দুটো গুনে খাওয়ার নয়। তার মাপ হল ‘মুঠো’। অর্থাৎ, এক মুঠো, দু-মুঠো বিস্কুট।
মহাকাব্যের আর এক অধ্যায়ে আছে ‘নোনতা’ বিস্কুট। সেই মাঝারি আকারের গোল বিস্কুটের গায়ে চারটে ফুটো। নোনতা বিস্কুটের অস্তিত্বের সঙ্গেও নম্বরের যোগ ততটা নেই। কারণ, একটা খাওয়ার পরেই মন বলে ওঠে, আর একটা। তার পর, আর একটা. . .এভাবেই একসময় ‘এক’ হয়ে যায় বহু।
বিস্কুট যখন মহাকাব্য, তখন ব্যাপারটা মোটেও হেলাফেলার নয়। তার একটা মর্যাদা আছে, একটা সম্মান আছে। তাই, একজন প্রকৃত বিস্কুটপ্রেমীকে চিহ্নিত করতে হলে জানতে হবে, তাঁর শৈশবে, কোনো এক শুনশান দুপুরে বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে, তিনি কি চুপি চুপি ফ্রিজ খুলে মাখন আর জ্যামের শিশি বের করে দুটি ‘একক’ বিস্কুটের গায়ে পুরু করে মাখিয়ে, তাদের চেপে ধরে, গা দিয়ে উপচে বেরোনো মাখন বা জ্যাম দু-চোখ বুজে জিভ দিয়ে চেটে খেয়ে দেখেছেন?
Jhaalmuri Winter Special 2016
Download the full magazine from the website: