রাজামশায়ের মনে সুখ নেই ।
তাঁর হাতিশালের হাতিরা আনন্দে কলাগাছ খাচ্ছে, ঘোড়াশালে ঘোড়ারা তালে তালে পা ঠুকছে আর কুচকাওয়াজ করছে | মরাই-ভরা ধান, মাঠ-ভরা ফসল, চাষীর মুখে হাসি আর ধরে না। রাজজ্যোতিষী অংক কষে মাথা নেড়েছেন, মঘা-অশ্লেষার দৌরাত্ম্য আপাতত বন্ধ ।বুড়ো রাজবদ্যি রাজামশায়ের নাড়ি টিপে বেজায় খুশি - বায়ু পিত্ত কফ সব ঠিকঠাক , চিন্তার কোনো কারণ নেই । সেনাপতি খবর পাঠিয়েছেন, রাজ্যের উত্তর -পশ্চিম সীমানায় যে দস্যুর দল জ্বালাতন করছিল, তাদের ধরে বেদম ঠ্যাঙ্গানি দেওয়া হয়েছে, তারা নাকে খত দিয়ে বলেছে এমন কাজ আর কখনো করবে না। তারা এখন সকাল-বিকেল মালপো খায় আর হরিনাম করে । গুপ্তচর রাতদুপুরে ফিসফিস করে বলে গেছে চাদ্দিকে সব শান্ত, গোলমালের কোনো আশঙ্কা নেই ।
হালুইকর নিয়ম করে পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করছে, বিকেলে জলখাবারের জিবেগজায় মিষ্টি কম পড়ছে না একটুও । তবু রাজামশায়ের শান্তি নেই মনে ।
রাজকন্যের বিয়ে দিতে হবে ।
বিয়ের যুগ্যি মেয়ে থাকলে বাপ-মা সব দেশে সব কালেই উতলা হয়ে ওঠেন, তার উপর মণিমালা বুড়ো বয়সের একমাত্র সন্তান, মা-মরা মেয়ে । তাকে পৃথিবীতে এনেই রানিমা টুপ করে চোখ বুজেছিলেন, সেই থেকে রাজামশায়ের ধ্যানজ্ঞান সব ঐ মেয়ে। আদরে যত্নে শাসনে সোহাগে তাকে বড় করেছেন তিনি। মেয়ে কাঁদলে কোলে নিয়ে সারারাত ঘুরেছেন, মেয়ের সামান্য জ্বর হলেও কাজকর্ম ফেলে পাশে বসে থেকেছেন দিনের পর দিন । রোজ সন্ধেবেলা মহলে ফিরে মেয়ের মুখ না দেখলে শান্তি নেই তাঁর। মেয়েও তেমনি বাপ বলতে অজ্ঞান । বাবাই তার পুতুলখেলার সাথী, তার গল্পগাছার সঙ্গী, বাবার সঙ্গেই তার যত খুনসুটি, আড্ডা, সুখদুঃখের আলোচনা । কতবার এমন হয়েছে, ভিনরাজ্যের দূত এসে বসে আছেন, মন্ত্রীমশাই ডাকতে এসে দেখেন, বাপ-মেয়েতে প্রাসাদের উঠোনে দশ-পঁচিশ খেলছেন। সন্ধেবেলা প্রাসাদের ঝুলবারান্দায় চা খেতে বসেন দুজনে, মণি কলকল করে কথা বলে যায়, রাজামশায় হাসিমুখে শোনেন আর মাঝেমধ্যে হাঁ হু করেন ।
মেয়ের বিয়ের কথা এখনই ভাবতেন না তিনি -- মেয়ে পর হয়ে যাবে ভাবতে কোন বাপেরই বা ভালো লাগে - কিন্তু প্রতিবেশী পলাশগড়ের রাজা যখন ইশারা-ইঙ্গিত ছেড়ে সোজাসুজি বললেন, মণিকে তাঁর ছেলের ভারী মনে ধরেছে, তিনি মণিকে ছেলের বউ করতে চান, রাজামশায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল । একে তো পলাশগড়ের যুবরাজ একটা আকাট মুখ্যু, কোনোমতে নাম সই করতে পারে মাত্র, তার উপর চেহারাখানা জাম্বুবানের মতন , আর মেজাজটাও যাকে বলে - ঠিক ইয়ে নয় !
তা ছাড়া, রাজামশায় খবর নিয়ে জেনেছেন, ইদানিং সে অস্থানে-কুস্থানে যাতায়াত শুরু করেছে । ওই মর্কটের হাতে তাঁর ফুলের মতন মেয়েকে তুলে দেওয়ার চেয়ে ওই যাকে বলে - কেটে জলে ভাসিয়ে দেওয়া ভালো। টকটকে রং, টানা চোখ, কাটা কাটা নাক-মুখ, এসব তো রাজার মেয়েদের থাকেই, মণিরও আছে, কিন্তু মেয়ে তাঁর লেখাপড়াতেও তুখোড়, সারা সকাল লাইব্রেরীতে কাটায়, একটা নাইট-স্কুল খুলবে বলে তোড়জোড় করছে আজকাল। সে ঘোড়ায় চড়ে, তলোয়ার খেলে, বর্শা চালায়, মাঝে মাঝে বুড়ো মন্ত্রীর সঙ্গে রাজকার্য নিয়ে আলোচনাও করে। এই মেয়ের বিয়ে ওই জানোয়ারের সঙ্গে ? ছ্যা ছ্যা ছ্যা!আর তিনি চোখ বুজলে মণিকেই তো রাজ্যের ভার নিতে হবে - সেটা সে পারবেও অবশ্য - কিন্তু অমন জামাই হলে দুদিনে সব উড়িয়ে পুড়িয়ে মেয়েটার হাঁড়ির হাল করে ছাড়বে ।
কিন্ত ব্যাপারটা সামাল দেওয়াও তো সোজা নয়।সোজাসুজি 'না' বললে পলাশগড়ের রাজা খেপে লাল হয়ে যাবেন, সৈন্যসামন্ত নিয়ে আক্রমণও করে বসতে পারেন - আশ্চর্য কি ! তাতে লাভের মধ্যে শুধু লোকক্ষয় অর্থক্ষয় ধনক্ষয় । তবে ?
রাজামশায় মাথা চুলকোতে থাকেন। হঠাৎ রানিমার উপর ভারী রাগ হতে থাকে তাঁর । নিজে কেমন সময় বুঝে ফুড়ুত হয়ে গেলেন, আর যত জ্বালা রইল তাঁর জন্যে । যতই হোক, ঘরের লোক ছাড়া কি এসব আলোচনা করা যায় ? টাকে হাত ঘসতে ঘসতে রাজামশায় চললেন বুড়িমার মহলে ।
বুড়িমা সম্পর্কে রাজামশায়ের পিসিমা হন । যৌবনে লাঠি খেলতেন, বিয়ে করেননি। এখন ছিয়াশি চলছে, এখনও সমান দাপট। পাকা আমটির মতন গায়ের রং, বাতে একটু কাবু হয়েছেন, কিন্তু চোখে ছানি পড়েনি, মাথাটাও দিব্যি পরিষ্কার। বিনা চশমায় দেশবিদেশের গোয়েন্দাগল্পের বই পড়েন, কখনও শব্দজব্দ করেন, কখনও কাঠ-কাঠালি দিয়ে কুটুম-কাটাম তৈরি করেন । একটিও দাঁত পড়েনি, রীতিমত ছোলাভাজা চিবিয়ে খান, আর নিত্যি দুবেলা রাজামশায়কে 'অপোগন্ড' , 'গোবরগণেশ' ইত্যাদি মিঠে সম্ভাষণে আপ্যায়িত করেন ।
রাজামশায় যখন বুড়িমার মহলে ঢুকলেন, তিনি তখন মন দিয়ে একটা কাঠের টুকরোয় রং লাগাচ্ছিলেন। রাজামশায় ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পালঙ্কে বসে পড়লেন ।
'ব্ড্ড বিপদে পড়েছি পিসি ।'
'তা পড়বি না কেন রে অলম্বুষ । ঘটে বুদ্ধি বলতে কিছু আছে নাকি? অঙ্কে তো টপাটপ ফেল করতিস। কি দেখে যে তোর্ বাপ তোকে সিংহাসনে বসিয়েছিল তা সেই জানে । তোর্ চেয়ে তোর্ রাঁধুনিরও মাথা ভালো । তা যাক গে , আজকের বিপদটা কি শুনি ? বদ্দিবুড়ো ভয় দেখিয়ে গেছে, শিগগির টেঁসে যাবি ? তা পোলাওতে ঘিটা কম করে - '
রাজামশায় অধৈর্য় হয়ে ওঠেন ।
'আরে দূর, ওসব নয় । ভাবছি, মণির বিয়ে দিতে হবে তো । এদিকে পলাশগড়ের রাজা আবার খবর পাঠিয়েছে, তার সুপুত্তুরের জন্যে সে মণিকে চায় । কিন্তু ওই ছেলের সঙ্গে আমি মেয়ের বিয়ে দেব না পিসি । একটা উপায় বাতলাও, লক্ষ্মী পিসি আমার ।'
বুড়িমা রং-তুলি ফেলে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন ।
'বলি মাথাটা কি একেবারেই গেছে? মেয়ের বিয়ে দিবি বলে যে নেত্য কচ্ছিস, সে বিয়ে করবে কিনা জিগ্যেস করেছিস তাকে ?’
‘ও হ্যা, তাও তো বটে - সেটা তো - ভেবে দেখিনি!’
'দেখিসনি তা তো জানিই। কাজের কাজ কবে করেছিস তুই?'
রাজামশায় আমতা আমতা করতে থাকেন।
'তা-তাহলে?'
'আবার কথা বলে! আরে, তুই বেছে দিবি কেন ? সে বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে, সে নিজে বেছে নেবে ।'
'পলাশগড়ের রাজাকে কি বলব তাহলে?'
'কি বলবি সেটাও আমি বলে দেব? তাহলে আর সিংহাসনে বসে আছিস কেন ? বনবাসে যা, দেখে আমার হাড় জুড়োক ।'
রাজামশায়ের তখন প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা । তাই দেখে বুড়িমা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠেন, তারপর মুচকি হেসে, মুখে একটা লবঙ্গ ফেলে, রাজামশায়ের কানে কানে একটা বুদ্ধি দেন।
পরদিন সকাল হতে না হতে রাজ্যজুড়ে খবর ছড়িয়ে গেল, আগামী পূর্ণিমা তিথিতে রাজকন্যা মণিমালা স্বয়ংবরা হবেন । শহরে বাজারে গ্রামে ঢ্যাঁড়া পড়ল - ' শোনো, শোনো , শোনো - ও- ও । সকলের সাদর আমন্ত্রণ । যে কেউ আসতে পারে, যেখানেই হোক তার জন্ম, যেমনি হোক তার ধর্ম, কুল, শীল, দরজা সবার জন্যে খোলা । শুধু একটি কথা, রাজকুমারীর জন্যে আনতে হবে উপহার । যার উপহার মনে ধরবে তাঁর , সেই পাবে তাঁর মালা ।‘
কাছে-দূরে ছোটো-বড়ো-মাঝারি রাজা-রাজড়া-রাজপুত্তুরদের কাছে পাগড়ি-পরা দূত পৌঁছে দিল সুগন্ধী কাগজে সোনার জলে লেখা পত্র - আগামী পূর্ণিমায় রাজকুমারীর স্বয়ংবর, তাঁরা যেন পায়ের ধুলো দেন, তবে আসতে হবে উপযুক্ত উপঢৌকন সমেত ।
দেখতে দেখতে দ্বাদশী এসে গেল। চারিদিকে সাজো সাজো রব । নিশানে, ফুলে, মালায়, আলোয়, বাজিতে, রোশনাইয়ে জমজমাট ব্যাপার । সারারাজ্যে হৈ হৈ রৈ রৈ, উৎসবের মেজাজ। কোথাও বাজীকর খেলা দেখাচ্ছে, কোথাও পথের ধারে মিঠাইয়ের দোকান, কোথাও মালিনী বসেছে বেলকুঁড়ির মালা আর জুইয়ের গোড়েমালা নিয়ে । মাঝে মাঝে রাজপথে শব্দ উঠছে খট খট, সকলে গলা বাড়িয়ে দেখছে, ওই এলেন অমুক রাজা চার ঘোড়ার রথে চড়ে, ওই গেলেন তমুক রাজপুত্তুর হীরেমোতিতে সর্বাঙ্গ মুড়ে, এই এলেন অমুক কোটালপুত্তুর সাদা আরবি ঘোড়ায় ।সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে আলোচনা, কার গলায় মালা দেবে রে রাজার মেয়ে ? হু-ই রাজাটা গেল, কি গোরা দেখেছিস? হ্যা রে, যে কেউ নাকি যেতে পারে সভায়? উপহার মনে ধরলেই হল ? আরে রাখ রাখ, রাজারা কত সোনারুপো আনবে, তা ছেড়ে রাজকন্যের অন্য জিনিসে মন উঠবে কেন?
বড়ো রাজারা, রাজপুত্রেরা অনেকেই এসে পড়েছেন, নতুন অতিথিশালায় তাঁদের থাকার ব্যবস্থা। ফরমায়েশের চোটে দাসী-চাকরেরা হাঁপ ফেলবার সময় পাচ্ছে না । মালা গাঁথতে গাঁথতে মালিনীর হাতে কড়া পড়ে গেল, পান সাজতে সাজতে পানসাজুনির প্রাণান্ত । রসুইঘরে দিবারাত্র উনুন জ্বলছে, এক রাজার ফুলকো লুচির বায়না মিটতে না মিটতেই আরেকজন কুড়মুড়ে বেগুনির জন্যে হাঁক পাড়ছেন। কারো স্নানের জলে চন্দনের গন্ধ না থাকলেই নয়, কারোর বা দুবেলা হরিণের মাংস না হলে মুখে গ্রাস ওঠে না।তুলনায় মন্ত্রি-সান্ত্রি -কোটালপুত্রদের বায়নাক্কা খানিক কম, কিন্তু নিত্যিনতুন আমোদ চাই তাদের। এই পায়রা ওড়াচ্ছে, এই মোরগের লড়াই বাধাচ্ছে, এই বলছে শিকারে যাবে । শ্রেষ্ঠীর ছেলেও এসেছে কয়েকটি, তারা দিনরাত ভয়েই সারা, এই বুঝি তাদের বাক্সপ্যাঁটরা চুরি হয়ে গেল। দেখেশুনে মন্ত্রীমশাইয়ের জুলপির চুল সব পেকে উঠল ।
রাজামশায় দেখেন আর রাগে দাঁত কিড়মিড় করেন। এই আপদগুলোর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়া দূরে থাক, এগুলোকে কানমলা দিয়ে বিদেয় করতে পারলে তিনি বাঁচতেন। কিন্তু এঁরা অতিথি, হুট বলতেই তো এদের ঘাড়ধাক্কা দেওয়া যায় না । মনের দুঃখে তিনি তলোয়ারটায় হাত বুলোতে থাকেন, আর ভাবেন, বুড়িমার কথাটা না শুনলেই কি ভালো হত ?
কিন্তু যার বিয়ের জন্যে এত তোড়জোড়, তার তাপ-উত্তাপ নেই । দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে লেখাপড়া করছে ঘোড়ায় চড়ছে, একদিন একপাল সখী জুটিয়ে পিকনিকও করে এল। রাজামশায় এক-আধবার নিজের একটু যত্ন-টত্ন নেওয়ার কথা বলেছিলেন, তা মেয়ে হেসেই গড়িয়ে পড়ল ।
স্বয়ংবরের দিন সকাল থেকে রাজবাড়িতে সাজো-সাজো রব । রাজসভা ঝকঝকে তকতকে করে মোছা হয়েছে, মেঝেয় বহুমূল্য গালিচা, চারপাশে ফুলের সাজ। সভায় দাসী কিংকরী সকলের নতুন পোশাক, হাতে নতুন রুপোর বালা। রক্ষীদের কোমরবন্ধ তরোয়াল ঝকমক করছে। দশটা বাজতে ডঙ্কায় ঘা পড়ল, একে একে পাণিপ্রার্থীরা এসে সভায় ঢুকলেন, গমগম করে উঠল ঘর । রাজামশায় এলেন বুড়িমা আর পাত্র-মিত্র-সভাসদ নিয়ে । আর সকলের শেষে, মলের রুমঝুম, শাড়ির খসখস আর গয়নার রিনঠিন আওয়াজ তুলে রাজকুমারী সভার মাঝে এসে দাঁড়ালেন । পরনে শ্বেতবস্ত্র, কপালে কুঙ্কুমতিলক, হাতে গলায় ফুলের সাজ, দীর্ঘ বেণী জড়ানো শ্বেতপুষ্পের মালায়। সখী বহন করে এনেছে বরমাল্য।
আবার ডংকায় ঘা পড়ল, শুরু হল স্বয়ংবর । সভাসুদ্ধু লোক অধীর আগ্রহে চেয়ে রইল, কে হবে যোগ্যতম? কে পাবে মালা ?
নিঝুমপুরের রাজকুমার উঠে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিলেন । কোমরে তলোয়ার গোঁজা, মাথায় হীরেবসানো পাগড়ি, গলায় সাতলহরা মুক্তোর হার । মোসাহেব বসে ছিল পায়ের কাছে, খুলে ধরল বাক্স, ঝিলিক দিয়ে উঠল পায়রার ডিমের মতন সবুজ পাথর একখানা । ভাট বলতে লাগল, ' এই পাথর তেরো নদীর পারে তেরো পাহাড়ের ধারে তেরো হাজার ক্রোশ দূরে চিচিংকাদের দেশ থেকে আনা । এই পাথর থাকত তাদের সর্দারের মুকুটে। এই পাথর যার কাছে থাকে, তার যৌবন থাকে চিরকাল । এই পাথরের জন্যে লড়াই চলেছিল তেরো মাস, শেষে তলোয়ারের এক কোপে সর্দারের মাথাটা নামিয়ে রাজকুমার উদ্ধার করে আনেন এই পাথর । এই পাথর একমাত্র রাজকুমারীরই উপযুক্ত ।' মণিমালা ভুরু কুঁচকে বললেন, ' হত্যাকারীর উপহার আমি নিই না কুমার । এই পাথর আপনিই বরং পাগড়িতে পরবেন ।'
এর পর মোহনগড়ের রাজা । বিশাল গোঁফ, ইয়া ছাতি, পায়ে জরিদার নাগরা । ইশারা করতেই তাঁর অনুচর মেলে ধরল একখানি শাড়ি , শরতের আকাশের মত আসমানী রং, নীল জমিতে সাদা ফুল, যেন ছড়িয়ে আছে চাঁদের কণা । তাঁর মোসাহেব মাথা দুলিয়ে বলতে লাগল, ' সাতশো লোক সাত মাস ধরে বানিয়েছে এই শাড়ি । রাত জেগে কাজ করেছে তারা , যাতে ভোরের শিশিরে নরম হয় শাড়ির বুনট । সেই সাত মাস কারিগরদের ছুটি হয়নি , তারা থেকেছে এমন ঘরে যেখানে সূর্যের আলো ঢোকে না, যাতে শাড়ির রং থাকে পাকা । শাড়ি তৈরী হলে কেটে নেওয়া হয়েছে তাদের আঙুল, যাতে আর না বানাতে পারে দ্বিতীয় এমনটি ।এ শাড়ি গায়ে দিলে মনে হবে বয়ে গেল বসন্তের বাতাস, মেলে দিলে মনে হবে আকাশের তারারা নেমে এসেছে মাটিতে ।' রাগে রাজকুমারীর মুখখানা কালো হয়ে উঠল । কেটে কেটে তিনি বললেন , ' এ শাড়ি গায়ে দিতে আমার ঘেন্না করবে মহারাজ । আমি বরং আপনার হয়ে ওই সাতশো কারিগরের কাছে মাপ চাইছি।আপনিও পারলে তাদের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নেবেন ।'
রাজকন্যে মালা হাতে পায়ে পায়ে এগোন, আশায় ঝলমল করে ওঠেন রাজা-রাজপুত্তুরেরা, মেলে দেখান তাঁদের আনা উপঢৌকন । কেউ এনেছেন জড়োয়ার হার, কেউ সোনার কোমরবন্ধ, কেউ সাত-রাজার-ধন-এক-মানিক , কেউ রামধনু-রং কথা-বলা পাখি । রাজকন্যে মাথা নাড়েন আর এগিয়ে যান, যিনি পিছনে পড়ে রইলেন, তাঁর মুখ আঁধার হয়ে যায়। পলাশগড়ের রাজপুত্তুরও এসেছিলেন, তিনিও বাতিলের দলে ।
এবার মন্ত্রি-সান্ত্রি-কোটালপুত্তুরদের পালা । কেউ এনেছে এক কোপে শত্রুকে দু টুকরো করে ফেলা যায় এমন তলোয়ার, কারো হাতে মুক্তোর গুড়ো, মাখলে মুখ ফুটফুট করে জোছনার মতন । বণিকপুত্র কেউ এনেছে বরফের দেশের হরিণের চামড়া, কেউ বা হাতির দাঁতের কৌটোয় গজমোতির মালা । তবু রাজকন্যের মন উঠল না কিছুতে ।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হল, দুপুর গড়িয়ে বিকেলও হয় হয় । রাজকন্যের হাতের মালা শুকিয়ে উঠল, পাত্রমিত্র বসে বসে ঘেমে নেয়ে গেল , চামর দুলিয়ে হাতে ব্যথা হয়ে গেল দাসীর, রক্ষীরা হাই তুলতে লাগল , রাজামশায়ের পর্যন্ত খিদে পেয়ে গেল - কিন্তু রাজকন্যের মনে ধরল না কাউকে ।
সবার শেষে ছিল এক চাষীর ছেলে । রঙটি চিকন শ্যাম, রোদে-জলে-মাটিতে শক্ত পেশল দেহ। সে তুলে ধরল একখানি লক্ষ্মীর ঝাঁপি । তাতে উপচে পড়ছে ধান, পাকা সোনার মত তার বর্ণ, ভোরের সূর্যের মতন তার আভা । মিষ্টি হেসে সে বলল,'এ ধান আমার নিজের হাতে বোনা । যখন মেঘে মেঘে কালো করে বর্ষা নামে, তখন মাঠে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বীজ । যখন উঁকি দেয় চারা, রাত জেগে পাহারা দিই আমরা তিন ভাই । ধান যখন গোলায় তুলি, শাঁখ বাজান মা, উঠোনে লক্ষ্মীর ছড়া দেন ।
বাতাসের মত মিহি, সুগন্ধী চাল আসে রাজার বাড়ি। তার চেয়ে সামান্য নিরেস যেটি, সেটি যায় পাত্র-মিত্র-কোটাল-সভাসদের ঘরে । প্রজার ঘরে ঘরে যায় বারোমেসে আতপ । মোটা চাল তুলে রাখা হয় বেছে। চালে-ডালে মিশিয়ে বড় হাঁড়িতে খিচুড়ি রাঁধেন মা , পথিকের খিদে পেল তো সে বসে পড়ল একখানা কলাপাত পেড়ে, গান গেয়ে বোষ্টম এল তো সেও পেল খানিক । সকলের খাওয়া হলে সাঁঝবেলায় খেতে বসি আমরা, আর ভুলো কুকুর ।ভুলো বসে আছে বাইরে, আমার কাজ ফুরোলে পথ দেখিয়ে আমায় বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। '
রাজকুমারী একটু ঘামলেন, একটু লাল হলেন, একবার মাথা নামিয়ে হেসে মালাখানি সেই নওলকিশোরের গলায় দিয়ে লজ্জায় রাঙা হয়ে দাঁড়ালেন । অমনি কাড়া নাকাড়া শিঙা শঙ্খ বেজে উঠল, সখীরা মুঠো মুঠো ছড়াতে লাগল ফুল আর আবির, সভাপন্ডিত হাঁ করে ঘুমোচ্ছিলেন, নড়েচড়ে উঠে বসে স্বস্তিবচন আওড়াতে লাগলেন । যারা প্রাসাদের বাইরে ভীড় করে ছিল খবর শুনবে বলে, তারা আহ্লাদে হাততালি দিয়ে নাচতে লাগল । রাজকুমারীর পোষা পাখি গলা ফুলিয়ে বলতে লাগল, 'কি মজা ! কি মজা !'
রাজামশায় এসে দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন - তাঁর মুখে হাসি, চোখে জল । মণিমালা লজ্জায় আরও লাল হয়ে তাঁর বুকে মুখ লুকোলেন ।
তার পর ? সানাই সুর ধরল, বাজি পুড়ল, আলো জ্বলল। রাজ্যসুদ্ধ লোক সাতদিন ধরে পোলাও কালিয়া মাংস মিষ্টি খেল । তারপর শুভদিনে গোধূলিবেলায় লাল চেলি পরে কপালে চন্দন এঁকে রাজকন্যে হাত ধরলেন চাষীর ছেলের ।উলুধ্বনির মাঝে চার চোখ মিলল, শাঁখের আওয়াজে শেষ হল সাতপাক ।বর-বউ দেখে সবাই একবাক্যে বলতে লাগল, দিব্যি মানিয়েছে, যেন হরগৌরী! অতিথি-অভ্যাগতেরা শুভকামনা জানালেন, প্যাঁচাপানা মুখ করে পলাশগড়ের রাজা পর্যন্ত আশীর্বাদ করে গেলেন ।
রাজামশায় আজকাল গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকেন আর ধানের চাষ কি করে বাড়ানো যায় তাই নিয়ে বইপত্র ঘাঁটেন । বুড়িমা হাঁস-মুরগির হাসপাতাল খুলেছেন, তাঁর নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। রাজকন্যে আর তাঁর নতুন বর ভাগাভাগি করে থাকেন প্রাসাদে আর গ্রামের বাড়িতে । রাজকন্যে বরকে আদবকায়দা শেখান আর সৈন্যদলের কুচকাওয়াজ দেখেন । রাজজ্যোতিষীর হয়েছে জ্ব্বালা, যতই পাঁজি দেখে লাউ-কুমড়ো খেতে নিষেধ করেন, নতুন জামাই সেসব শোনেন না ।ভুলো আরেকটু বুড়ো হয়েছে, কিন্তু তেজ কমেনি একটুও। বাঘের মতন থাবা পেতে দরজায় বসে থাকে, আর অচেনা কাউকে দেখলেই ডাক ছাড়ে - ভৌ !
Story by +anwesha sengupta for Jhaalmuri Winter Special
Read the e-magazine here http://issuu.com/suparnachakraborti/docs/jhaalmuriwinterspecial2015
Previous works of the author
Swapad
Mahanagar
Jhaalmuri
Spread Creativity. Spread Happiness.
No comments:
Post a Comment
Please share your valuable feedback