রোজের একঘেয়ে কাজের বেড়াজাল টোপকে খোলা আকাশের নীচে মুক্তির শ্বাস নেবো ঠিক করলাম । ঝট কোরে নেওয়া সিদ্ধান্ত। তাই ছোট্ট ছুটির ফাঁকে মানে সপ্তাহান্তের ছুটিতেই আমাদের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিলাম তাজপুরকে।বাঙলার ভ্রমণ মানচিত্রে তুলনামূলক নতুন দিশা ।
দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের তদারকিতেই, তাজপুর , শীতের ছুটির পর্যটকদের জন্য সেজে উঠছে ।দিঘা যাওয়ার মূল রাস্তায় বালিসাই মোড় থেকে তাজপুরের রাস্তা বেঁকে গেছে ।দুইধারে মাছের ভেড়ীর মাঝে উঁচু বাঁধের ওপর সদ্য পিচ ঢালা মসৃণ একটাই রাস্তা চলে গেছে এঁকে বেঁকে তাজপুরের অন্দরে;শেষ হয়েছে সমুদ্রের ধারে মোহনার কাছে ।
তাজপুরের প্রায় সমস্ত হোটেল ,রিসোর্ট এই রাস্তার দুই ধারে গড়ে উঠেছে ।আমরা বেছে নিলাম নিউ সোনার বাংলা রিসোর্টটিকে।রিসোর্টটির প্রধান আকর্ষণ সামনেই বিস্তৃত ঝাউবন।এই ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে দশ মিনিট হাঁটলেই তাজপুরের সৈকত ।আমরা রিসোর্টে চেক-ইন করেই দৌড়লাম সমুদ্র-স্নান উপভোগ করার উদ্দেশ্যে।মাঝপথে ঝাউবনের নিস্তব্ধ সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দি করলাম।তখনও জানিনা সৈকতে আমাদের জন্য দুটো চমক অপেক্ষা কড়ছে। প্রথম চমক সৈকতে আমরা সাতটি মানুষ ছাড়া আর একটিও মানুষ নেই।তবে যারা আছে তাদের দেখেই দ্বিতীয় চমকটা লাগলো। সৈকত ভরে আছে ছোটবড় লাল কাঁকড়ায়।কিছুক্ষণের মধ্যেই সাতটি মানুষ ও সহস্র লাল কাঁকড়ার মধ্যে শুরু হল লুকোচুরি খেলা।মিনিট পাঁচেক পর হতাশ মানুষের দল নিমগ্ন হল সমুদ্র স্নানে।
দলের কনিষ্ঠতম সদস্য টিনটিনের প্রথম সমুদ্রস্নান,তাই সমুদ্রের নোনাজলের ঢেউ প্রাথমিকভাবে ভ্যাবাচ্যাকা বানালেও আনন্দ লাভে দেরি হয়না। দেড় ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন ভাবে ঢেউয়ের সাথে লড়াই,খেলা,হুটোপুটি করে রিসোর্টে ফেরার উদ্যোগ নেওয়া হল। এতখানি সময়ের মধ্যেও সৈকতে একটিও মানুষকে দেখতে পেলামনা।
রিসোর্টে ফিরে খাওয়া পর্ব সেরে বেরিয়ে পড়লাম তাজপুরের বিখ্যাত সৈকতে সূর্যাস্ত দেখার আশায়।আশা ব্যর্থ হলনা।দেখলাম কিভাবে অস্তগামী সূর্যের কিরনে সৈকত হোয়ে ওঠে স্বর্ণাভ। ধীর অলস পায়ে হাঁটতে থাকলাম মোহনার দিকে।
মোহনার উল্টোদিকে মন্দারমনি।তাজপুর সৈকতের এই অংশটিতেই কয়েকটি চা-জলখাবারের দোকান রয়েছে তাই কিছু মানুষের সমাগম হয়েছে।প্রতিটি দোকানেই কয়েকটি করে দড়ির ঝোলা টাঙ্গানো আছে। সন্ধ্যা নামতেই দূরে মন্দারমনির হোটেলের আলো জ্বলে উঠলো একটা দুটো করে। আলোময় ঝলমলে জগত থেকে অনেক দূরে থাকায় শহুরে ক্লান্তি হল এক নিমেষেই উধাও। ফিরতি পথে লক্ষ্য করলাম এক বিশেষ ব্যবস্থা।একটি নোটিশ বোর্ডে লেখা রয়েছে ‘তাজপুর সৈকতে গাড়ি চালানো নিষেধ ,কারন এখানে লাল কাঁকড়ার বাসস্থান রয়েছে’। বেশিরভাগ উন্নয়নমুখী পর্যটনকেন্দ্রের স্থানীয় পরিবেশ ও প্রাণীর বিনাশ ঘটে থাকে।তাজপুরের ক্ষেত্রে স্থানীয় উন্নয়ন পর্ষদ তাই প্রথম থেকেই দুটি বিষয় সম্পর্কে সতর্ক রয়েছে।সৈকতের ধারে কোন হোটেল ও রাস্তা গড়ে তোলা হয়নি ।
পরেরদিন সকালে সৈকতে গিয়ে দেখি সমুদ্র সরে গেছে প্রায় ১কিমি দুরে,আর তাই বিস্তৃত বালুতটে চলছে অ্যাডভেংচার স্পোর্টসের ব্যবস্থা ।একটি জীপের পিছনে দড়ির সাথে প্যারাস্যুট যুক্ত করা হচ্ছে যেটা একজন মানুষের দেহে লাগানো থাকছে ।জীপ সামনে এগোলে মানুষসহ প্যারাস্যুটটি আকাশে উড়ছে ।ফলে কয়েক মুহূর্তের জন্য মানুষ নিজেকে পাখি বলে অনুভব করবে। সত্যিই অ্যাডভেঞ্চার।বাঙ্গালি নাকি ভীতু জাতি ,কিন্তু এই পাখি হওয়ার বাসনার জন্য যা লম্বা লাইন দেখলাম,তাতে প্রবাদটিকে সত্য বলে মনে হল না ।
ফেরার পথে অনুভব করলাম ধীর উন্নয়ন ও সীমিত পর্যটক সংখ্যা এই সৈকতকে এখনও রেখেছে তরতাজা,আদিম,সুন্দর।তাই ভয়হয় পরের বার এখানে এসে, একি রকম ভাবে পাবো কি তাজপুর সৈকতকে?
Travelogue by Anindita Das
No comments:
Post a Comment
Please share your valuable feedback