Monday, September 29, 2014

শেষ চিঠি


হ্যালো রাই,                                                                                       কলকাতা
                                                                                                 ২০-১-২০১৩
 
তোমাকে লিখতে বসা প্রথম চিঠি, ডাকব কি বলে বা শুরুই বা করব কিভাবে তা ভাবতে গিয়ে খান কতক পাতা নষ্ট করে ফেললাম। তুমি কেমন আছো তা জানতে চাওয়ার কোনও অর্থ নেই। আজ হঠাৎ এতদিন পর তোমাকে লিখতে গিয়ে অনেক কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আজ মনে হচ্ছে তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম আর আজকের দিন টা একই ওয়ার স্রোতে ভাসছে। সেদিনও বৃষ্টি পড়ছিল, তুমি অটো থেকে নামতে গিয়ে ছাতা সামলাতে ব্যাস্ত ছিলে। চৈত্র মাস ছিল কিনা বলতে পারবনা কিন্তু আমার মনে সর্বনাশের ঝড় হয়ত তখন থেকেই বইতে শুরু করেছিল।
না থাক, এতদিন পর সেইসব প্রসঙ্গ না তোলাই ভাল। আমিও হয়তো ভুলে গেছি অনেক কথাই। তোমার সাথে প্রথম কিভাবে কথা শুরু হয়েছিলো তা আমি মনে করতে পারিনা। একটা কমন ম্যাথম্যাটিক্স ক্লাস ছাড়া তো আমাদের মধ্যে দেখাও হতো না। তবুও আমি সেই ক্লাসটার জন্য অপেক্ষায় থাকতাম, তোমার পিছু নিতাম ঠিক পেছনের সিটটা দখল করার জন্য। তোমার রনিদার চায়ের দোকান টা মনে পড়ে? রনিদার চায়ে তুফান তুলে যখন সবাই বাম কংগ্রেসি তরজায় ব্যস্ত থাকতো আর তুমি, রীতা আর তোমার সেই ঝগড়ুটে বান্ধবীটি হেটে যেত আমি রাজনীতি ছেড়ে জীবনের এক স্বপ্নিল পরিনতির জাল বুনতাম। রীতা আর কমলের জুটিটা তৈরি হতে এক বছর লেগে গেল। সেকেন্ড ইয়ার থেকেই রীতার বডিগার্ড তুমি আর কমল, তোমাকে ব্যস্ত রাখার জন্য আমাকে ভাড়া করা শুরু করল। এরকম পড়ে পাওয়া সুযোগ হাতছাড়া করার মতো বোকা অবশ্যই আমি ছিলাম না। ভিক্টোরিয়া থেকে ময়দান, কখনও বাবুঘাত থেকে হাওড়া ব্রিজ এভাবেই কেটে যাচ্ছিল বেশ। আমরা ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম। আচ্ছা তোমার সেই দিনটার কথা মনে পড়ে? বাগবাজার ঘাটে বসে হাওড়া ব্রিজ উপচে পড়া সন্ধ্যা দেখছিলাম। এক ঝাক পাখি উড়ে যাচ্ছিল রোজনামচা শেষে। আমি তোমাকে জিগ্যেস করেছিলাম এই পাখির দল রোজ বাড়ি ফিরে যায়, আশ্রয় নেয় ভিন্ন ভিন্ন গাছের খাজে, কিন্তু পালা বেঁধে তারা ফিরে কিভাবে? তুমি বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে
তারপর আমার চুলগুলোতে আলতো হাত বুলিয়ে বলেছিলে – জীবন যদি এক সুতোয় বাধা থাকে তো সেই সুতো চোখে না দেখা গেলেও তোমাকে আমাকে বেঁধে রাখবে। যেখানেই থাকো না কেন ফিরিয়ে আনবে আমার কাছে। - কথা গুলো বলতে বলতেই তুমি অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলে। দুচোখের কোনে মুক্তোর মতো চিকচিক করছিল গোধূলির দুঃখ। তোমার দুঃখ আমার বিস্ময়কে আঁকড়ে ধরেছিল। দুজনের চেতনা দুজনের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে তোমার ঠোট শুষে নিয়েছিল আমার পরম প্রাপ্তির বাসনাকে
তোমার জন্য কয়েকটা লাইন ও লিখেছিলাম যদিও তা দেওয়া হয়ে ওঠেনি কখনও।

যখন তুমি রইবে একা, মনের আধার ঘরে
ক্লান্তি হয়ে ছোব তোমার ঠোট, গড়ব বাসা তোমারি অন্তরে
দুচোখ ভরে অঝোর ঝরে যদি ডাকলে আমায় মনে
অশ্রু হয়ে ছোব তোমার ঠোট, স্বরলিপি বুনবো তোমার সনে
বাদল বেলার ঘনঘটা যদি নামে আকাশ করে কালো
বৃষ্টি হয়ে ছোব তোমার ঠোট, বাসব তোমায় নিজের করে ভালো।

তিনটে বছর কেটে গেল দেখতে দেখতেআমি চলে এলাম মাস্টার্স করতে। আর তুমি ডাক্তারিতে ভর্তি হয়ে গেলে। মাসে একটা করে ফোন আর একটা করে চিঠি। দুজনের মধ্যে যোগাযোগ যত ম্লান হতে লাগল পুরনো স্মৃতি গুলো যেন আর আঁকরে ধরতে লাগল আমাকে। তুমি কোনোদিন আমাকে তোমার মনের কথা বলনি, আমিও আর গড়পড়তা পাঁচটা ছেলের মতো আমাদের বন্ধুত্ব কে আগে বাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারিনি। ধিরে ধিরে গঙ্গার হাওয়া অ্যাটলান্টিকের শীতলতায় হারিয়ে গেল। তোমার চিঠি ইউ এস পি সের দরজায় কড়া নাড়া বন্ধ করল। আমরা হারিয়ে গেলাম কর্ম জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিলাসিতায়। পরে কমলের কাছে জেনেছিলাম যে তুমি কোনও এক ডাক্তার ক্লাসমেট কে বেছে নিয়েছো তোমার জীবন সঙ্গী হিসাবে। আর আমি? আমি তো আজও সেই প্রিন্সেপ ঘাটের ভাঙ্গা কংক্রিট সিঁড়িতে আটকে আছি। জোয়ারের জল গুলো এসে আমার স্মৃতি তে ধাক্কা দিয়ে যায়। আর দিনের শেষে যখন সাহচর্যের ভাটা আসে একাকীত্ব অক্সিজেন খুজতে থাকে স্কচ আর সিগারেটের ধোঁয়ায়। 
দেখতে দেখতে ত্রিশটা বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে বোহেমিয়ান জীবন যে কখন আমার লাংগস টাকে শাসিয়ে অকেজো করে গেছে বুঝতেই পারিনি। তার উপর হার্টের চোখ রাঙানি। জীবন যখন আমার সাথে শেষ বোঝাপড়ার হিসেবটা করে নিতে চাইছে আমি তাই দেশেই ফিরে এলাম। হাজার হোক আমার ই দেশ তো। যা দিয়েছে আর কেড়ে নিয়েছে তা সবই তো এই দেশ। তাই শেষ জীবনের এই জুয়া খেলাটার সুযোগ আর হাতছাড়া করতে পারলামনা। কিন্তু মূলকাণ্ডহীন এক পঞ্চাশোধর চিকিৎসার ঝক্কি ও তো কম না। যেখানে সব বড় বড় হসপিটাল আগাম আমার মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করে দিয়েছে সেখানে কেই বা সই করবে বন্ডে। তাই সব হিসেবপত্র শেষে বেছে নিলাম এই নার্সিং হোম টাকে। নিজের দেওয়া বন্ডে সই করে ভর্তি হয়ে গেলাম। মৃত্যু যখন অনিবার্য তখন তা যদি তোমার হাতে আসে তা তো চরম পাওয়া। আমার হার্টের সার্জারি করছ তুমি আর তা বদলাতে তুমি শেষ বারের মতো ব্যর্থ হবে। আমার হৃদয়ের স্পন্দন ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসবে তোমার চোখের সামনে। একটাই দুঃখ থাকবে আমি তখনো তোমায় দেখতে পাবনা। ঘুমের মধ্যেই আমি ভেসে যাব এই ধুলো ভরা শহরের বাতাসে। তবু তুমি ভালো থেকো। 
এই চিঠির তুমি উত্তর লিখতেই পারো। শুধু চিঠি পাঠাবার ঠিকানা টা জানা থাকবেনা।
                                                                                                   ভালো থেকো,
                                                                                                          মৃত্যুঞ্জয় 

Composed by Rajib Chowdhury for Jhaalmuri Puja Special 2014


No comments:

Post a Comment

Please share your valuable feedback

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...