Tuesday, January 21, 2014

আদালত ও একটি রায়

A Story by Rajib Chowdhury

                        (১)
আমি সমীর।সদ্য কলেজ পাশ আউট।ব্যাচের বাকিদের মত আমিও একটা চাকরীর খোজে।বাবার টাকার জোগানটা এখনও অঢেল বলে আমার চিন্তাটা অবশ্য অনেক কম।সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়ি।ব্যস সারাদিন ঘুরে বেড়াই। কোনদিন কোনো পার্ক, কোনোদিন জেলখানার সামনে বা কোনদিন হয়ত শিয়ালদা বা হাওড়া স্টেশনে বসে দিন কাটিয়ে দেই।শহর গ্রামে শিলান্যাশ যতটা হয়েছে সেই হারে বেকারত্ব যদি নাশ হতো তাহলে আমার মত ছেলেদের দুপুরে অন্তত এভাবে রাস্তা ঘাটে ফ্যাল ফ্যাল নয়নে জনগননা করতে হতনা।তবুও এইভাবে বসে থেকে কলকাতা আর তথাকথিত গজিয়ে ওঠা কলকাতার লোকজনের কর্মকাণ্ড আর জীবনের ফেরারী কা সওয়ারী হওয়াটাও খুব খারাপ লাগেনা আমার। আজ আমার গন্তব্য দায়রা আদালত।কোরটের রুমে বসে বিভিন্ন চরিত্রের মেলবন্ধনে যে অদ্ভত রিয়েলিটি শো হয় তার সঙ্গে কারো তুলোনা চলেনা।

কোর্ট রুমে ঢুকে প্রথমে কেসটার একটা সামারী নিয়ে নেওয়টা খুব দরকার।গভিরহাট মহকুমার একটা প্রত্যন্ত গ্রাম কামধেনু।চাষী অধ্যুষিত গ্রাম।শিক্ষা এখানে মিড ডে মিলের প্লেটে বিক্রি হয়। সাক্ষরতা এয়ারকন্ডিশ্ন ঘরের বুজে যাওয়া ঘুলঘুলির মধ্যে আটকে পরা বাতাস। এই গ্রামেই ঘটে যাওয়া এক অপরাধের শুনানি আজ।গ্রামের চাষী রফিক মণ্ডলের কিশোরী কন্যাসমার শ্লীলতাহানী ও আত্যহত্যায় প্ররোচনা।

জজ সাহেবকে দেখে বেশ ভালই লাগল।বেশ গোলগাল তরমুজের মত চেহারা।চশমাটাকে নাকের কাছে নামিয়ে ফাইলগুলো নেড়ে চেড়ে দেখছেন।সরকার পক্ষের উকিল আসামির বিপক্ষে দফা ৩০১,৩৭৬,৩৭৫,৩৮৫ ধারায় মামলা দায়ের করার অনুমতি চাইলেন।এই উকিল রা কিকরে ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের এই সংখ্যা মনে রাখেন তা সত্যি খুব আসছরযের।এই প্রযন্ম না হলে ভুলে গেলে স্মার্ট ফোনে সার্চ মারতে পারে কিন্তু এই পঞ্চাশ পার করা উকিল যে কি করে  এত দিন সামলালেন তা বিস্ময়কর।উকিল বাবুর এই দাবী শুনে বাকি লোকজন অবাক নয়নে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করে দিল।সামনে বসা পুলিশ কন্সটেব্ল তার বাবু ক ফিস ফিস করে বলল  স্যার এই সেকশন গুলোও পাবলিক কে বিলিয়ে দিলেন স্যার।

জজসাহেব সরকার পক্ষের উকিলবাবুকে কাল ভোরে ঘটে যাওয়া ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করতে বললেন।উকিল বাবু ইংরেজি আর বাংলার মিক্স পাঞ্চে উকিলসুলভ ভাষায় যা বললেন তার সারমর্ম তা প্রায় এরকম যে সেদিন কাকভোরে আসামী কমলার ঘরে ঢুকে শ্লীলতাহানী করে এবং কমলা অপমানে দড়িতে আত্মহত্যা করে।কিন্তু আসামীকে জেরা করবার কোন উপায় নেই কারন তার জনসমক্ষে উপস্থিতি সাধারনের বিপদ নিয়ে আসতে পারে এবং আসামি জনরোষের সম্মুখিন হতে পারেন। তাই উকিল বাবু কোণ প্রত্ত্যক্ষ্যদড়শিকে জেরা করার অনুমতি চাইলেন। ভারতবর্ষে দোষীদের নিরাপত্তায় যা খরচ হয় তা যদি সাধারন মানুষের জন্য হতো তাহলে অন্তত কিছু লোকের কে এফ সি চিকেনের ঢেকুড় তুলে অফিস কামাই করে মোমবাতি নিয়ে আন্দোলন করতে হতনা ।

রফিক মন্ডল কাঠ গড়ায় এসে মিথ্যে না বলার প্রতিশ্রুতি দিল যদিও তার বোঝার শক্তি ছিলনা বই টিকে ছোয়ালে যদি সত্য বিনা মিথ্যা না বলার অদ্ভুত ক্ষমতা সঞ্চার হ্য তাহলে আসামীদের সোজাসুজি এই কাজটা করালেই ল্যাটা চুকে যায়।

যখন ঘটনটা ঘটেছিল তখন কমলার কাছে কে ছিল- উকিল বাবু প্রশ্ন করেন ।
ওর দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা আসে বাবু।তারাই রা পারতাসিলো  রফিক গলার গামছাতে ঘাম মুছতে মুছতে জবাব দেয়।
-যখন কমলার ওপর হামলা হয়েছিল কোণ চিৎকার শুনেছিস তুই?
-হা বাবু।শুনসি।হে তো সন্ধ্যা হইলেই কমলা ডাহে।তা বুঝবন ক্যামনে কেল্লেইগ্যা ডাক পারসে।
-তা তুই বুঝলি কি করে কমলার রেপ হয়েছে?- রেপ কথাটা এখন এত চলিত হয়ে গেছে যে নিরক্ষর রফিকদের ও আর বোঝাতে হয়না এর মানে।
-ওসব অত জানিনে বাবু।বেটির বুহের কাসে হারামজাদা দাত বসাইয়া গেসে,মা মা চিতকারে ছটফট করতে করতে মরতি দেখলাম । দরজা দিয়া ফালাইতে দেখলাম মরদাডারে। এহন এইডারে আপনি যা কইবেন কন। হ্যেরে কে ফিরাইব।

জজসাহেব আসামি পক্ষের কোন উকিল নিযুক্ত হয়েছে কিনা জানতে চাইলেন।তা না হয়ায় অবিলম্বে তা নিয়োগ করে পরের দিন আবার শুনানির দিন ধার্য করলেন।
  
                                        (২)


আসামি পক্ষের উকিল নিযুক্ত হওয়ার পর আবার কাজ শুরু হল।আসামি পক্ষের উকিল আবার রফিক মন্ডলকে জেরা করবার অনুমতি চাইলেন। পুলিস ইতিমধ্যে রিপোর্ট জমা দিয়েছে।কমলার বুকে আসামির চিহ্ন পাওয়া গেছে।

রফিক আমি আবার তোর কাছে জানতে চাই যে কমলা যে রেপ হয়েছে তা তুই বুঝলি কি করে?  উকিল বাবু কাঠ গড়ার ওপারে কোণ শ্রেনীর লোক দাড়িয়ে আছে তা বুঝে নিয়ে গলার স্বর ওপরে তুলে নিলেন।
-          বাবু আধখামচা শরীর নিয়া কাতরাইতে কাতরাইতে মিইস্যা গেল।
-          তাতে কি প্রমান হয়ে যায়?
-          কমলার কটা বাচ্চা?
-          দুইট্যা বাবু।
-          কমলার চরিত্র আগে থেকেই যে বাইরের মুখো তা আদালত কে গোপন করা হয়েছিল।স্যার আমি আদালত কে একটি বিষয়ে অবগত করতে চাই যে রফিক মন্ডল কমলাকে তার রোজগারের এক অঙ্গ বানিয়ে নিয়েছিল।কমলার বাচ্ছার কোনো রেকর্ড নেই।এর আগেও রফিক টাকার লোভে কমলা দু মাসের দুটো বাচ্চাকে বিক্রি করেছে।
-          জজ সাহেব এই বিষয়ের সত্যতা জানতে চান।
-          রফিক কাচুমাচু শরীরে বলল  জী হুজুর।কোনো উপায় তো আসিল না।আগেরবার সব ধান খরায় শুকায়া গেল।কোনো টাকাই উথলনা। এ বছর ফলন ভালই হইসিল।শহরের গোদামে নিয়া গেলাম।বাবু কইলেন অতি ফলন।দাম পামুনা ভাল।মহাজনের টাকা মেটাইতে আর উপায় আসিল না।
-          এটাকি সত্যি তুমি কমলাকে নিয়ে অন্য চাষীদের বাড়ি যেতে আর কমলাকে নোংরা কাজকরমে ব্যবহার করতে।
-          হ্যাতে অন্যায় কি বাবু। যা করলে দুইটা লোকের পেট ভরব তা করলে দোষ কি বাবু।
-          স্যার আমার মনে হয় এটাই যথেষ্ট যাতে প্রমানিত হয় যে কমলা অতিশয় দুশ্চরিত্রা ছিল। সে তার দেহ কে বাইরের সমাজের কাছে ব্যাবহার করেছে।আসামী নাবালক হওয়ায় মুহূর্তের প্রলোভনতায় অন্যায় করে ফেলেছে।

এক নতুন মোড় নিয়ে আসলেন আসামী পক্ষের উকিল।জজ সাহেব আসামির বয়সের রিপোর্ট জানতে চাইলেন।পুলিশ রিপোর্টএ জানা গেল স্থানীয় কোনো যায়গায় বয়স নির্ধারণ করা যায়নি কারন তেমন কোন পরিকাঠামো নেই এই অঞ্চলে।

কেসটা বেশ জটিল ও মজাদার হয়ে উঠছে।এত্ত বড় দেশ।৬০ কোটি লোক নিজেদের শিক্ষিত বলে দাবি করে।সেখানে একটা জানা অপরাধকে শাস্তি দিতে বিচারব্যবস্থার আঙ্গুল কাপছে।একটা সাবালক অপরাধ যদি নাবালক করে তাহলে তার দোষ কে মার্জনা করা যায় অনায়াসে।পুলিশ রিপোর্ট থেকে জানা গেল যে আসামির বয়স নির্ধারণ করা যায়নি।তবে তার জিন বিন্যাস থেকে যতটুকু বোঝা গেছে যে যৌবনকালে অবতীর্ণ হলে সে সাড়ে ৫  ৬ ফুট লম্বাই হত।কিন্তু বর্তমানে সে তার থেকে ৫ ইঞ্চি কম আছে। এর থেকে তার কৈশোরকালের অস্থিরমস্তিস্ককে প্রমান করা যেতেই পারে।উকিল বাবুর হোম ওয়ার্ক সরকার পক্ষের উকিলের থেকে বেশ ভাল মনে হছে।

জজসাহেব রায় শোনানোর আগে একটা বিরতি চেয়ে নিলেন।আমিও সওয়াল জবাবের মাঝে বুদ্ধির গোড়ায় ধোয়া দেওয়ার সুযোগ পেলাম।চা আর ধোয়ার অদ্ভুত সমন্বয় সঙ্গে বাঙ্গালির আর্থ সামাজিক চিন্তা যে কে কিভাবে শুরু হয়েছিল তা কোনও উইকিপিডিয়াও খোজ করতে পারেনি।
 চা খেতে খেতেই ভাবছিলাম কামধেনু কান্ডের কথা।একটা মেয়ে গ্রামে রেপড হল।গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করল।যে এত বড় অন্যায় করল সে নাবালক। তার বয়স তার অন্যায়কে লঘু করে দেয় আর রফিক মন্ডলের দারিদ্র কমলা কে বানিয়ে দেয় দুসচরিত্রা।আমাদের  সমাজ আর আইন কাকে দোষী করবে?মায়ের থেকে মাতৃত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার অপরাধ বেশি না ক্ষিদের তাড়নায় জীবন থেকে শ্বাস কেড়ে নেওয়া বেশি দণ্ডনীয়। নানা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল হঠাৎ খেয়াল করলাম যে আদালতের শুনানির সময় হয়ে এসেছে।তড়িঘরি করে দৌড় লাগালাম আদালতে।

জজসাহেব মুখে সুপারীর দানা ভরে সব কাগজ নিরীক্ষনে ব্যস্ত।রফিক মন্ডলের ছখে মুখে হতাশা।আমরাও অধীর আগ্রহে বসে আছি তথাকথিত ভার্ডিক্টের জন্য।অবশেসে মুখ খুললেন তিনি।

সব সাক্ষ্য আর রিপোর্ট অনুসারে এই কেসটা আমাদের কাছে খুব ই লজ্জার।কমলার এই দুঃখজনক মৃত্যুয় অভিযুক্ত পরোক্ষ ভাবে জড়িত।আসামির বয়স্ কে বিবেচনা করে এই সিধান্তে উপনীত হয়েছি যে যাবজ্জীবন বা মৃত্যু আদেশের মত কঠিন শাস্তি তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিতে পারে এবং আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে বিনষ্ট করতে পারে।তাই সব দিক বিবেচনা পূর্বক আমি রফিক মন্ডলের পোষ্যা গাভীর জন্য ১০০০০ টাঁকা ক্ষতিপূরণ এর নির্দেশ দিলাম।আর গোয়ালঘরে অবৈধ অনপ্রবেশের জন্য সাপ টিকে ৩ মাসের জন্য গভিরহাট মহকুমার বনসমপদ বিভাগের হাতে তুলে দেবার নির্দেশ দিলাম।


আদালত ভেঙ্গে গেছে।ফেরার বাসের টাইম টা জানতে হবে।আবার দৌড় লাগালাম নিজের মনেই হাসতে হাঁসতে।

No comments:

Post a Comment

Please share your valuable feedback

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...