Thursday, February 26, 2015

পরিচয়


শিপ্রা রাণী দেব। আমার বিবি। শিপ্রা রাণী নাম টা হয়ত বিবি নিজেই ভুলে গেছে। বিবি যখন আমাদের বাড়িতে কাজ করতে এসেছিল যখন ওর বয়স- নয় বা দশ। বয়সটা ঠিক বিবি জানে না।বুড়ি মাসি – মানে ওর মা, আমাদের বাড়িতে কাজ করত।আমার তখন জন্মই হয়নি। দাদার জন্মের পর ওকে দেখার জন্য মাঝ বয়সি একটা মেয়ে খোঁজা হচ্ছিল।একদিন ভোর বেলা বুড়ি মাসির ছ নম্বর মেয়ে - যার নাম শিপ্রা রাণী দেব, মার হাত ধরে এসেছিল আমাদের বাড়িতে।আমার মা ওকে নাম জিজ্ঞেস করতেই বলে ছিল শিপ্রা।মা বললো নাম টা ভাল, কিন্ত সবসময় ডাকার জন্য একটা ছোট্ট সোজা নাম হলে ভাল হয়।ওই দিন থেকে শিপ্রার নাম হয়ে গেল শিবি।শিবি খুব ভাল ভাবে আমাদের বাড়ীর জীবনের সাথে মিশে গেল।কিছু দিনের মধ্যে পরিবারের সদস্য হিসেবেই জায়গা করে নিল।

এবার আমি জন্ম নিলাম।কথা শেখার পর ‘শিবি’ আর কোন ভাবে উচ্চারন করতে পারলাম না। তাই শিবি হয়ে গেল বিবি। আমার বিবি। বিবি আমাদের সব আবদার মেটাতো।আমার চুল বেধে দেওয়া ,সাজিয়ে দেওয়া, খাইয়ে দেওয়া সব বিবির কাজ ছিল।মার থেকে বিবির কাছে আমাদের আবদার ছিল বেশি। ও রকম ভাবেই জীবন কাটছিল সবার।বিবি নিজের বাড়ি যখন যেত, তখন আমি, দাদা আর ভাই খুব কান্নাকাটি করতাম।সাত দিনের ছুটিতে গিয়ে আমাদের কান্না কাটির ঠেলায় দুদিনে ফিরে আসত বিবি।

আমরা বড় হচ্ছিলাম আর বিবি যুবতী।হঠাৎ একদিন, বুড়ি মাসি বাপি আর মার কাছে বললো বিবির বিয়ের কথা। মা ও বাপি, বিবির বিয়ের দায়িত্ব নিজেদের হাতেই নিয়েছিলেন।এবার শুরু হল বিবির জন্য ছেলে খোজা।বুড়ি মাসি একটা দুটো বিয়ের সম্বন্ধের খবর নিয়েও আসছিল।ওর কাছেই জানা গেল ছেলের বাড়ির যৌতুক এর দাবীর কথা।মেয়ে একটু হলেও পড়াশুনো জানতে হবে, অন্তঃত নিজের নামের হস্তাক্ষরটা পারতেই হবে।আর কিছু সোনা-দানা, ছেলের জন্য একটা আংটি আর একটা সাইকেল দিলে তো কথাই নেই।সোনা দানা, ছেলের আংটি, সাইকেল ইত্যাদি দেওয়াতে কোনো অসুবিধাই ছিল না। মা বাপি তার চেয়ে বেশিই দেবেন ভাবছিলেন, কিন্ত বাধ সাধল বিবির পড়াশোনা।

বিবি সব দিকে খুব গুনী ছিল।কিন্ত স্কুলে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি ওর। তাই অ-আ-ক-খ বলুন আর A,B,C,D - সব কিছুই ওর কাছে কালো অক্ষর ছিল।বাড়িতে সবাই বেশ চিন্তায়, কি হবে এখন? সবাই  মিলে বিবিকে অ,আ শেখানোর চেষ্টায় বসলেন। বিবিও চেষ্টা শুরু করল। কিন্ত সাত দিনে কি আর পনের বছরের শিক্ষা দেওয়া বা নেওয়া যায়।তাই সবই গুলিয়ে যাচ্ছিল।ওদিকে আরো একটা পাত্রের খবর নিয়ে এলো বুড়ি মাসি। ছেলের বাড়ির লোকদের বাড়িতে আসার দিনও ঠিক হয়ে গেল। কিন্ত্ এদিকে বিবি যে অ, আ তেই আছে। ক,খ তে কবে যাবে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না।তাই ঠিক হল শুধু নামটাই ওকে শেখানো হবে। শিপ্রা রানী দেব। বারবার বিবি ওই নামটা লিখছিলো। নামটা বিবি লিখতে শিখে গেল বা বলব জোর করে শেখানো হল।

ছেলের বাড়ির লোকরা এলো সন্ধেবেলা।বাড়িতে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব ছিল।বিবির সাথে আমরা ভাই বোনেরাও সেজে গুজে রেডি। মা, বাপি, বুড়ি মাসি আর বিবির কিছু আত্মীয় স্বজন। প্লেট ভরতি মিষ্টি আর সিঙ্গাড়া খাওয়ার পর পাত্রের মা বিবিকে জিজ্ঞেস করলেন – ‘পড়তে লিখতে পারো?’ বিবি আমাদের সবার মুখের দিকে একবার তাকালো।তারপর বললো নামটা পারি।ভদ্রমহিলাও মেয়ে কিনতে এসেছিলেন।তাই যাচাই করতে ছাড়েননি। জানি না নিজে কতটুকু পড়াশোনা করেছিল।ছেলে তো ছিল ক্লাস এইট ফেল।বললো – ‘নাম টা লিখে দেখাও’।বিবি আবার আমাদের দিকে তাকালো আর কাঁপা কাঁপা হাতে খাতা পেন্সিল টা তুলে নিল নিজের কোলে।নাম টা বিবি লিখেছিল। কিন্ত ভয়ে ওর হাত টা কেঁপে গিয়েছিল। তাই লেখাটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। ব্যাপার টা ভদ্রমহিলার ঠিক পছন্দ হলো না।পরের প্রশ্ন তাই ছিল বাবার নাম টা তবে এবার লেখ। বিবি ভয় পেয়ে গেল।আর ওর সাথে আমরা সবাই।বিবি তো শুধু নিজের নাম টাই শিখেছিল, বাবার নাম টা তো ছিলো সিলেবাসের বাইরে।তাই ওই যাত্রায় বিবির বিয়ে টা আর হলনা।ও রকম অনেক লোক আসলো বিবির জীবনে, থালা ভর্তি মিষ্টি, সিঙ্গাড়া খেলো এবং শিপ্রা রাণী দেবের কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লেখা নামটাও দেখে গেল।বিয়ে আর ঠিক হয়না বিবির।বুড়ি মাসি খুব চিন্তায়, আর ওকে দেখে আমার মা বাবা। তবে যা হয়, ভগবান নামের ভদ্রলোকটা সবার জন্যই কাউকে না কাউকে ঠিক করেই রাখে। বিবির জীবনেও ওই ভদ্রলোক চলে এলেন।বিবি কিন্ত কাঁপা কাঁপা হাতে ওর নাম টা ওই ভদ্রলোকের সামনেও লিখেছিল।বিয়ে হল বেশ ধুমধাম করেই। বিবি বেশ খুশি খুশিই শ্বশুর বাড়িতে জীবন কাটাছিল।আর আমরা ওকে ছাড়া থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।

বিবি অন্তঃসত্ত্বা, আমি তখন ক্লাস সিক্সে, বুদ্ধিটা বরাবরই পাকা ছিল আমার।বিবিকে বললাম, “দেখ কোনো ভাবে যেন পাঁচ-ছটা ছেলে মেয়ে তোর হয় না”। বিবি গম্ভীর ভাবে আমার কথা শুনত আর এমন ভাব করত যেন দশ বছরের ‘আমি’ মেয়েটা সংসার সম্মন্ধে সব জানি।বিবি কে উপদেশ দিতে বেশ ভাল লাগত আমার।নিজেকে বেশ বড় বড় মনে হত। ২রা অক্টোবর বিবির ছেলে হল - নাম রাখা হল মোহন।আবার আমি উপদেশ দিলাম। বিবি ওকে কিন্ত খুব পড়াশোনা করাতে হবে।বিবি চিন্তায় পড়ে যেত। কিন্ত নিজের অন্ধকার জীবন টা যেন ছেলের না হয়, সেই চেষ্টাই চালিয়ে যেত।ছেলেটার স্কুলে ভর্তির সময় হল। ইনটারভিউএ বিবি কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারেনি। তাই ওর ছেলের অ্যাডমিশনটাও হয়নি। ভগবানেরও বিবির জন্য কষ্ট হচ্ছিল।ছেলেটা তাই হয়তো পড়াশুনোয় ভাল হয়েছিল।

জীবন চলতে লাগল ,অ আ ক খ আর বিবির জীবনে এলনা। কিন্ত বিবির ছেলে মাধ্যমিকে ফিফ্থ পজিসন এ আসলো। পেপার এ মোহন এর নাম বেরোল।মা বাবা কেও জিজ্ঞেস করেছিল নানা প্রশ্ন।বিবি চুপ করেই বসেছিল, পাছে ওর নিরক্ষরতার খবর বেরিয়ে পড়ে। আমার ওই দিন বিবিকে অনেক শিক্ষিত মনে হচ্ছিল।অ আ বিবি শেখেনি, কিন্তু জীবনের শিক্ষায় ও শিক্ষিত ছিল।

আজ বিবির ছেলে স্বনামধন্য ডাক্তার। গাড়ি ,বাড়ি সবই করেছে। খুব ভাল ছেলে। বিবি কে খুব ভাল করে রেখেছে।বিবি আমায় ডেকেছিল ওর বাড়িতে।ওর নতুন বাড়ির নেম প্লেটটার মধ্যে বড় করে লেখা ছিল শিপ্রা রাণী দেব।শেষ পর্যন্ত ‘শিপ্রা রাণী দেব’ নিজের নাম টা সবাই কে জানাতে পারলো।

বিবি কিন্ত আমার বিবিই থাকবে। আর আমাদের ছেলে মেয়েদের বিবি মাসি বা বিবি পিসি।


Story by +Baishali Ghosh 



Jhaalmuri 

Spread Creativity. Spread Happiness.
http://from-the-jhalmuri-corner.blogspot.in/
mail: thejhaalmurigang@gmail.com

Publication

  

1 comment:

Please share your valuable feedback

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...