Wednesday, January 27, 2016

আমার মত


কিছু কিছু  মানুষ থাকেন যাদের সান্নিধ্যে  এলে মন আপনা থেকেই ভালো হয়ে যায়। যারা শত রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ, কষ্ট বুকে চেপে রেখে অনাবিল আনন্দে গা ভাসিয়ে দিতে পারেন। পরের দিনটা বাঁচবে্ন কি না তার নিশ্চয়তা নেই জানা সত্ত্বেও তাঁরা আজকের দিনটিকে প্রাণভরে উপভোগ করেন। এমনই একজন মানুষ ছিলেন আমার কাকা, আমার মত।

এই ‘মত’ নামের পেছনে একটা ইতিহাস আছে। আমার জন্মের পরে আমাকে তখনো আমাকে মায়ের কাছে এনে দেওয়া হয়নি। কাকা আমাকে দেখে এসে মাকে বললেন, “বউদি, তোমার মেয়ে দেখতে একেবারে আমার মত হয়েছে”। শুনে মায়ের কি চিন্তা। কারণ কাকার গায়ের রঙ মিশ্‌ কালো। আর ভারতবর্ষে মেয়েদের গায়ের রঙ কালো হওয়া মানে তো ঘোর সর্বনাশ। তাই আমার ভারতীয় মা চিন্তান্বিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে কাকা সকল সময় আমাকে বলতেন, “তুই বড় হয়ে আমার মত হবি”। শুনতে শুনতে আমি কাকাকে মত বলে ডাকতে শুরু করি। উল্টে কাকাও আমাকে মত বলে ডাকতে শুরু করেন এবং আমরা একে অপরের ‘মত’ হয়ে উঠি।
মত ছিল অসম্ভব প্রাণবন্ত একটা মানুষ। তার মাথায় সবসময় বিচিত্র সব বুদ্ধির আনাগোনা হত। আশেপাশের গোমড়ামুখো মানুষগুলোকে নির্মল আনন্দে ভাসিয়ে দিতে মত সদা তৎপর থাকতো। আবালবৃদ্ধবনিতা প্রত্যেকের সাথেই একই ভাবে মিশত মত। কর্মক্ষেত্রেও একই ভাবে জনপ্রিয় ছিল মত। আমরা থাকতাম একটা ছোট পাহাড়ি শহরে। সেখানের বাঙালি সমাজে রসিক মানুষ হিসেবে সবাই মতকে একডাকে চিনত। প্রচুর বন্ধু বান্ধব ছিল মতর। 

মতর চোখের মণি ছিলাম আমি। আমার পুরো ছোটবেলাটাই মতর সংস্পর্শে কেটেছে। অনেক কিছুই আমার মতর কাছে শেখা। মত ছিল আমার ছেলেবেলার বন্ধু, আমার খেলার সাথী, আমার দুষ্টুমির সাগরেদ, আমার আব্দারের জায়গা। আমার বাবারা ছিলেন দশজন ভাইবোন। তাই যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে বাড়িতে প্রচুর লোক জমা হত। আমরা সব খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো, পিসতুতো ভাই বোনেরা মিলে সে কি হুল্লোড় করতাম। আর আমাদের দলপতি হত এক এবং অদ্বিতীয় মত।

আমার বাবার একটাই বিলাসিতা ছিল জীবনে। সেটা হল ছুটির দিনের ঘুম। এক রবিবারে বেলা দশটা পর্যন্ত বাবা ঘুমোচ্ছেন আর তাঁর নাক ডাকছে। মত সেই নাসিকা গর্জন একখানা টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করে রেখেছিল। পরে সেটা শুনে সবার কি হাসি। আর একবার আমার জ্যাঠতুতো দিদি মুক্তার শাশুড়ি মৃত্যুশয্যায়।  সবাই বিমর্ষ। মত ঘটনাচক্রে সেখানে উপস্থিত ছিল। হঠাৎ বলে উঠল, “আমার এখুনি একটা চিঠি লিখতে হবে”। শুনে সবাই বলে উঠল, “কাকে চিঠি লিখবে?” মত বল্‌ল, “মুক্তার শাশুড়ির হাতে মা বাবার (অর্থাৎ আমার স্বর্গতঃ দাদু ঠাকুমার) জন্যে একটা হাত চিঠি পাঠিয়ে দেব”। শুনে সবাই একচোট হাসল। এই ছিল মত। তাঁর আশে পাশে লোক চুপ করে দুঃখ পেয়ে বসে থাকবে, সেটি হবার নয়। 

যেদিন আমি প্রথম স্কুলে ভর্তি হই, সেদিন মায়ের সাথে মতও গিয়েছিল আমাকে নিয়ে। ফেরার পথে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে মত বাসে চেপে অফিসে চলে গিয়েছিল। সেদিন বাসে মতর পকেটমার হয়ে সাতশো টাকা খোয়া গিয়েছিল। সেই থেকে মত ঠাট্টা করে বলতো, “তোর কাছে আমার সাতশো টাকা পাওনা আছে”। আমার বিয়ের দিন আমার বরকেও মত সেই সাতশো টাকার দুঃখ শুনিয়েছিল।
তখন আমার বয়েস বোধহয় সাত বছর। এক রবিবারে মতর শখ হল আমার চুল কেটে দেবে। সেই চুল কাটার পর্ব চলল ঘণ্টাখানেক ধরে। চুল কাটা শেষ হবার পর মত বললো, “বাঃ, ফাইন হয়েছে”। তারপর কোন এক অজ্ঞাত কারণে ব্যস্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেল। এদিকে আয়না দেখে আমার তো চক্ষুস্থির  । এমন ভাবে চুল কাটা হয়েছে যে, যেই দেখছে মুচকি হেসে চলে যাচ্ছে। চুল কোথাও লম্বা, কোথাও ছোট, কোথাও বা স্রেফ খালি। রাগে আগুন হয়ে আমি কাঁচি হাতে মতর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সেদিন যখন মত ফিরেছিল, তখন আমি মতর মাথায় এলোপাথাড়ি কাঁচি চালিয়ে গোছা গোছা চুল কেটে ফেলেছিলাম। পর দিন মতর অফিস আর আমার স্কুল। দুজনেই টুপি পরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম।

আমার বই পড়ার অভ্যেসটাও মতর জন্যেই তৈরি হয়েছিল। মত রোজ শোবার আগে আমাকে বই থেকে গল্প পড়ে শোনাত। আর রোজই গল্পের মাঝপথে এসে থেমে বলতো, “আজ আর নয়, আমার ঘুম পেয়েছে”। বাধ্য হয়ে বাকি গল্পটা আমার নিজেই পড়ে নিতে হত।

মত অনেক কঠিন বিষয়কে সহজ করে বোঝাতে পারত। একটা সামান্য উদাহরণ দিচ্ছি। তখন আমি অনেক নিচু ক্লাসে পড়ি। পরীক্ষার আগের দিন lieutenant বানানটা কিছুতেই শিখতে পারছিনা। মত এসে বললো, “ শোন, এভাবে মনে রাখবি, মিথ্যা তুমি দশটা পিঁপড়া, এই কথাটা ইংরাজিতে অনুবাদ করলেই হয়ে যাবে”। আজও lieutenant বানানটা আমার এভাবেই মনে রয়েছে। মত একবার আমায় বলেছিল, “জানিস, মাত্র ৫০ নম্বরের জন্যে ম্যাট্রিকে আমি অংকে লেটার পাই নি।“ এই রকম ছোট ছোট অসংখ্য ঘটনা আমার স্মৃতিতে ভিড় করে আছে।

আমার এই প্রাণবন্ত, হাস্যরসপ্রিয় মতর শরীরে কঠিন রোগ বাসা বেঁধেছিল। যৌবনে মাত্রাতিরিক্ত ধূমপানের ফলে মতর ফুসফুস দিন দিন জীর্ণ হয়ে পড়ছিল। খুব কষ্ট পেত মত। শ্বাসকষ্ট লেগেই থাকত। কিন্তু এত অসুস্থতার মধ্যেও একটি দিনের জন্যেও মতর মুখের হাসি মিলিয়ে যায়নি। যখনই প্রশ্ন করতাম, “কেমন আছ?”, মত হাসিমুখে বলতো, “ ফাইন, ফাইন”। 

আজ মত নেই। শেষবার যখন শরীর বেশী খারাপ হল, তখন হাসপাতালে যাবার সময় অ্যাম্বুলেন্সে আমার কাঁধে মাথা রেখে মত একটু বাতাস পাবার জন্যে কি আকুলি বিকুলি করছিল। আকারে ইঙ্গিতে আমাকে বলছিল, “এবার আর ফিরে আসবো না”। সেবার এত কষ্টের মধ্যেও হাসপাতালে থাকাকালীন মত আমার জন্মদিন মনে রেখেছিল। এই পৃথিবীতে মতর মত মানুষ খুব কম জন্মায়। তারা শুধু অপরকে আনন্দ দিয়েই যায়। নিজের কষ্ট কাউকে বুঝতে না দিয়ে সবাইকে হাসি গল্পে ভুলিয়ে রাখে। বিনিময়ে কতটা ভালবাসা পেল, তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা থাকেনা। মতর কাছে শেখা জীবনের এই শিক্ষা আমাকে অনেক কঠিন পরিস্থিতিতে সাহায্য করেছে। 


Jhaalmuri Winter Special 2016


No comments:

Post a Comment

Please share your valuable feedback

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...