Wednesday, May 6, 2015

হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ



যে হারায় সে কি লম্বা হারায় , ছোটবেলায় পাশের  বাড়ির শুভ কাকু একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে দোকানে গেল, আর ফিরল না। আমরা তখন ভাড়া থাকি উত্তর  কলকাতার এক বাড়িতে , তখন ও প্রতিবেশীরা আত্মীয়র  থেকে কিছু কম হত না। পাশের বাড়ির দাদু তখন চাকরি করত একটা জুটমিলে আর ফেরার পথে কিছু না কিছু বাজার করে আনতো আমার জন্য , কোনদিন বাদাম ভাজা , কোনো দিন ডেইরি মিল্ক , কিছু তো থাকতই  , বলতে নেই ওই বয়স থেকেই আমার চরিত্রের একটা জিনিস আবিষ্কার করে আমি নিজেই খুশী  হয়েছিলাম যে আমি ভীষণ স্বার্থপর, রোজ সন্ধে বেলা কিছু ফী মাল হাতে পেতাম বলে ওই বাড়ির দাদু বাদ দিয়ে আমি বাকি কাউকে বিশেষ পাত্তা দিতাম না।

আর শুভ কাকু লোকটাকে তো দেখতেই পারতাম না , মায়ের কাছে শুনেছি মাধ্যমিকে ধেরিয়েছিল , কিন্তু আমার সাথে দেখা হলেই পড়া ধরত, ট্রান্সলেশন জিগ্যেস করত, তখনকার দিনে কি সব cadaverous লোক হত মাইরি, এই শুভ কাকুর  মতো লোক জনের বহু আগেই হারিয়ে যাওয়া উচিত ছিল , তো যাই হোক ছেলেটি আর  ফিরল না , থানা, পুলিশ ,হাসপাতাল, মর্গ কেউ ওর মুখ দেখে নি বলল  , আমি খুব খুশি হয়েছিলাম বলে হালকা চড় চাপড় ও জুটেছিল  আমার কপালে , ওই বয়সে যা হয় আর কি।  এর কয়েক বছরের মধ্যেই দাদু দিদা ভাড়া ছেড়ে উঠে গেল , এমনিতেও বুড়ো লোকটা ছেলে হারানোর দুঃখে এত মন মরা হয়ে পরেছিল যে পাশের বাড়ির একটা ছেলে যে তীর্থের কাকের মতো বসে রোজ অপেক্ষা করে সেটা ভুলেই গেছিল। আস্তে আস্তে অভ্যেস ও হয়ে যাচ্ছিল আমার , ওরা চলে যেতে বিশেষ কষ্ট হয় নি ।

একটা এমনিতেও ভেঙ্গে পরা একটা লোক আর  একটা বিভিন্ন মায়ের মন্দিরে আর বাবার  থানে পুজো দিতে দিতে শুকিয়ে যাওয়া আধ পাগলা দিদার কথা  মনে রাখতে আমার বয়েও গেছে , আমার সামনে তখন অনন্ত  জীবন, প্রায় ক্লাস নাইন, পুজোয় একা বেরোনোর স্বাধীনতা , রোজ বিকেলের দিকে মন কেমনের একটা হাওয়া দেয়, একটা সাইকেল জুটে গেছে, কোচিং এ আবার মেয়েরাও পড়তে শুরু করেছে , আমার জীবন থেকে পাশের বাড়ির অতিথি পরায়ন চিরকাল আপোষ না করা আদন্ত ছাপোষা লোকটা আস্তে আস্তে চুপিসাড়ে হারিয়ে গেল।

ওই বয়সে ভুলে যাওয়া খুব সোজা ছিল, তবু কি সব ভুলে যাওয়া গেছে? আরে যে মেয়েটার সাথে আলাপ হলো হরিদ্বারথেকে ফেরার সময়, দুদিনের ট্রেন জার্নি , কত গল্প হয়েছিল, কায়দা করে জেনে নিয়েছিলাম ওর কোনো বিশেষ বন্ধু নেই তখনও; হাওড়া স্টেশনে আকুল মুখ করে কাঁপা কাঁপা হাতে যে বাড়ির ফোন নম্বরলেখা কাগজ টা দিয়েছিল, তা বহুদিন ছিল ডায়রির ভাঁজে। আমিও তো বীর, এক টাকার টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করে একটা গম্ভীর গলা শুনে ফোন কেটে দেওয়ার পর আর ফোন করার সাহস  হয় নি কোনোদিন। শুধু হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজটা ছিল বহুদিন, যা হারায় তা কি একেবারেই  হারায়।

আমাদের খেলার মাঠের শেষ এ পুজোর আগে কয়েক গুচ্ছ কাশ ফুল দেখে পাগল হয়ে যাওযার দিন কি মাঠ বোজানো ফ্ল্যাট হওয়ার সাথেই হারিয়েছিল, জানি না, কিম্বা এক কালে মামাবাড়ির ছাদে উঠে মফস্বলি সন্ধে বেলা যত দূর দেখার  আরাম আর সেই  দৃষ্টি কি হারিয়ে গেল তবে, মাসিদের বিয়ে হয়ে গেল, মামারা আলদা হয়ে গেল, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে চুরে ছোট থেকে ছোট হয়ে গেল,  সেই ডাইনিং টেবিল হারিয়ে গেল, পুরনো রেডিও ওর মতো, ছোট ছোট হাত চলতি FM  এলো , বাড়ির পুরনো কালো ফোনটার মতো বাতিল আর গম্ভীর জিনিস রইলো না তাহলে বলছ।

দিদার হাতের পুলি পিঠে রইলো না , মাথার কগাছি চুল বাদ দিয়ে বাকি কিছু থাকবে না বলছে , চোখের নিচের কালো দাগ আর  সব সময় অবসন্ন ক্লান্ত থম মেরে থাকা এই লোকটাকে এখন আমি যদি দেখতাম আমার ওই বয়সে, শুভ  কাকুর থেকেও খারাপ লাগত, একজন  তো তবু পালিয়ে বেঁচেছিল, আমার কি হবে। আমার তো  হারানোর কোনো কারণ নেই।

আস্তে  আস্তে আমার পায়ে হেঁটে ঘোরা পুজো গুলো হারিয়ে গেল, আজকাল রাস্তার দোকানে এগ রোল খেতে বউ বারণ করে দিয়েছে, hygienic নয়, আর হাত গড়িয়ে টমেটো সস নেমেছিল মনে আছে, কি ক্যাবলামো রে বাবা, শ্বশুড় বাড়ির লোকের সামনে।

আচ্ছা সব হারানোর  পেছনে কারণ থাকে বুঝি, এই যে এত ভালো ভালো সময় আড্ডা মেরে হারিয়ে গেল, চপ মুড়ি তেলে ভাজা মাখা তাও আবার চাঁদা করে কেনা, সেই দিনটা হারিয়ে গেল, শেষ হয়ে গেল সিগারেট কাউন্টার খাবার দিন।

আমাদের যা না বলা কথা ছিল সেই সব শেষ বিকেলের মলিন হাওয়ায় হারিয়ে গেল , শীতকালের  পিকনিক এর ফেলে আসা প্লাস্টিক এর গ্লাস এর মতো পেছনে পরে রইলো গাড়ির চাকার দাগ, ঝিমিয়ে আসা মলিন নদীর তীরে এক ফালি গ্রাম, কয়েক ঘর বসতি, আর এক গোছা মানুষ, প্রাপ্তি বলতে এই বেঁচে থাকা, লং শটে পরে থাকা কয়েক গুচ্ছ কাশ ফুল, "ট্রেন দেখবি অপু" বলে দুর্গার black and white পথের পাঁচালি যা দিদার চোখে দুরের বাংলাদেশ এর মতো এই অস্পষ্ট স্বপ্নের , কবিতার মতই সহজ কিন্তু সহজ লভ্য নয়।

আমরা যারা আজকাল আয়নার সামনে দাড়ালে নিজেদের ছবি খুব স্পষ্ট দেখতে পাই না, আমাদের যারা বেশির ভাগ লোক এই ভুলে যেতে বসেছে,আর মাত্র কয়েক বছর, আমরাও পরে যাব অনভ্যাসের খাতায় , সবটা মুছে যাবে কি, আমাদের সব রঙ্গিন গল্প ফেলে আসা রঙিন পাতা কেউ কি কুড়িয়ে নেবে না, আমরাও তো আর সহজ লভ্য নই, এরপর না হয় একটু বিরতি আসুক। পাহাড়ের পথ বেঁকে যাক অনিশ্চয়তা থেকে আরো  অনিশ্চয়তার দিকে, সঙ্গে রাখুক হারানো , প্রাপ্তি আর দীর্ঘ নিশ্বাস টানার মতো নিরুদ্দেশ।

Story by +amlan dutta for Jhaalmuri Boisakhi


1 comment:

  1. আমাদের সাধারন জীবনের ঘটনাগুলো আসাধারন ভাবে লেখা।
    সাধুবাদ অম্লান কে।

    ReplyDelete

Please share your valuable feedback

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...