শৈলশহরটির
নাম করিব না। এটুকু বলিলেই যথেষ্ট,
সেখানে আমাদের একটা বাড়ি ছিল। আমার
পিতৃদেব মজলিশী লোক ছিলেন, একটা
বড়সড় সরকারী চাকুরীও করিতেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল,
অবসর লওয়ার পরে সকলে মিলিয়া সেই
শৈলগৃহে বাস করিবেন । কিন্তু বিধাতাপুরুষ উল্টা বুঝিলেন,
অবসর লইবার পূর্বেই তাঁহাকে তাঁহার
প্রয়োজন পড়িল। মাস ছয়েকের ভিতর তিন দিনের
জ্বরে মা-ও তাঁহার অনুগমন করিলেন। ছোট বোনটি আরও বছরখানেক টিঁকিয়াছিল,
একদিন অসাবধানে সিঁড়ি দিয়া নামিতে
গিয়া তাহার পা ভাঙিল, সে
আর সুস্থ হইল না।
বাড়িতে
আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীদের ভীড় কমিলে মনে পড়িল,
আমি বিবাহ করি নাই এবং আমার ব্যাঙ্কে
বেশ কিছু টাকা আছে । অতএব, আমি
একজন মুক্তপুরুষ। ভাবনাটা ক্রমশঃ জোরালো হইয়া উঠিলে মনে হইল,
কোথাও চেঞ্জে যাওয়া দরকার। পরদিনই
টিকিট কাটিলাম এবং তাহারও সপ্তাহখানেক পরে লটবহর সমেত রাত্রির ট্রেনে চড়িয়া
বসিলাম।
খাইয়া
আসিয়াছিলাম, ট্রেনে
উঠিয়া বিছানা করিয়া শুইয়া পড়িলাম। গলা অবধি কম্বল টানিয়া একটা ডিটেকটিভ উপন্যাসে
মনোনিবেশ করিলাম। একটা দারুণ লোমহর্ষক স্থানে আসিয়া পড়িয়াছি,
এমন সময় কে যেন ডাকিল,
'আরে,অমরদা
যে !'
বিরক্তি
চাপিয়া চাহিয়া দেখি, কলেজের
নরেন । সে আমার চেয়ে বছরতিনেকের ছোট,
কলেজে থাকিতে নাটকের দলে মাঝেমধ্যে
একসঙ্গে অভিনয় করিয়াছি।কলেজ ছাড়িবার পরে তাহার সহিত যোগাযোগ ছিল না,
আজ এতদিন বাদে আবার দেখা ।
বই
বন্ধ করিয়া উঠিয়া বসিলাম। নরেন সামান্য মোটা হইয়াছে,
রংটা আগের চেয়ে ময়লা,মাথার
সামনের চুল ইতিমধ্যেই পাতলা হইতে আরম্ভ করিয়াছে। কিন্তু মুখের হাসিটি একই রকম আছে
।
জিজ্ঞাসা
করিলাম, 'কোথায়
যাওয়া হচ্ছে ?'
খানিকটা
অপ্রস্তুত হইয়া বলিল 'এই
একটু বেড়াতে - ইন্দু, এদিকে
এসো।' একটি
হাস্যমুখী বধূ উল্টোদিকের সীটে বসিয়াছিল,
উঠিয়া আসিয়া নমস্কার করিল। জানা গেল,
আমার এবং উহাদের গন্তব্য একই ।
হাসিয়া
জিজ্ঞাসা করিলাম, ' তাহলে
হনিমুনে চলেছ বল !'
নরেন
একটু হাসিয়া বলিল,
' ওই
আর কি - আসলে মোহনের একটা বাড়ি আছে,
সেখানেই থাকব । মোহন আমাদের বিয়েতে
থাকতে পারেনি, তাই
চিঠি লিখে যেতে বলেছে।ইন্দু তো মোহনের বন্ধুর বোন হয়।'
নরেনের যমজ ভাইয়ের নাম মোহন। নাম
শুনিয়াছিলাম, কোনোদিন
দেখি নাই।
'মোহন
কি করছে ওখানে?'
'গাছগাছড়া
থেকে ওষুধ বানিয়ে বিক্রি করে - নিজের ল্যাবরেটরী খুলেছে একটা। চিঠিতে তো বলে ভালই
চলছে ব্যবসা। দেশে ফিরতে চায় না, বলে
- এখানেই বেশ আছি ।'
গল্প
জমিয়া গেল । ইন্দিরা বেশ মেয়ে। আধ ঘন্টার ভিতর আমাকে 'দাদা'
পাতাইয়া ফেলিল,
আমার আপত্তি সত্ত্বেও নিজেদের বাক্স
হইতে ল্যাংচা খাওয়াইল, এবং
আমি বিবাহ করি নাই বলিয়া আক্ষেপ করিল।
বিবাহ করিলে পুরুষের কি দুর্গতি হয় বলিতে
যাইব, সীটের তলা হইতে একটা কেঁউ কেঁউ
আওয়াজে চমকাইয়া উঠিলাম। ইন্দিরা কিন্তু ঘাবড়াইল না,
সীটের
তলা হইতে একটা বাক্স টানিয়া বাহির করিল ।
ডালাটা খুলিতেই গলায় লাল রিবন বাঁধা একটি কালো রঙের হৃষ্টপুষ্ট সারমেয়শাবক লাফাইয়া
বাহির হইয়া আসিল এবং ইন্দিরার কোলে চড়িয়া এতক্ষণের বন্দিদশায় আপন অসন্তোষ প্রকাশ
করিয়া, পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া
তাহার গাল চাটিতে লাগিল| ইন্দিরা তাহাকে দুই-একটা মৃদু বকুনি
দিল বটে, কিন্তু তাহাতে প্রশ্রয়ের ভাগই যে
অধিক, তাহা মানুষেও বোঝে, কুকুরের কথা বাদ দিলাম ।
নবদম্পতি পোষ্য লইয়া মধুচন্দ্রিমা
যাপন করিতে যায়, পূর্বে কখনও দেখি নাই, কিছুটা আশ্চর্য হইলাম। সে ভাব বোধকরি
আমার মুখেও ফুটিয়া উঠিতেছিল,
নরেন
আমতা আমতা করিয়া বলিয়াই ফেলিল,
'আসলে
ইন্দুকে ছেড়ে একদন্ড থাকতে চায় না,
জানেন? একদিন ওকে রেখে আমরা দু-ঘন্টার জন্যে
বেরিয়েছিলাম,এসে দেখি, তিনি হাত পা ছড়িয়ে পড়়ে আছেন, পুরো একদিন কিছু খাওয়ানো গেল না ।
এমনিতে ব্ড্ড মিশুক কিন্তু - কোকো ,
একটু
আদর করে দাও তো !'
বাস্তবিকই ভারী মিশুকে কুকুর ।লেজ
নাড়িতে নাড়িতে নিঃসংকোচে পা বাহিয়া উঠিয়া সে আমার কোলে চড়িল, বার দুয়েক শুঁকিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া
আমার নাকে জিভ বুলাইয়া বড়ো কালো চোখ মেলিয়া আমার দিকে তাকাইয়া রহিল। আমি কুকুর
দারুণ ভালোবাসিতাম এমন নহে, কিন্তু কোকো আমার আড়ষ্টতা কাটাইয়া
দিল । তাহার মাথায় হাত বুলাইলাম,
বিস্কুট
খাওয়াইলাম, সে আনন্দে কুন্ডলী পাকাইয়া আমার কোলে
ঘুমাইয়া পড়িল ।
----------------------
ট্রেনের সময় ভোর সাড়ে পাঁচটা, খানিকটা কুয়াশা জমিয়াছিল বলিয়া
ঘন্টাখানেক দেরী হইল। মোটঘাট নামাইয়া একটা গাড়ির সন্ধানে বাহির হইব, ইন্দিরা আসিয়া ধরিল।
'পালাচ্ছেন যে?'
'সে কি,
বাড়ি
যেতে হবে না?'
'সে তো হবে, তা বলে গুটিগুটি চলেছেন কোথায়? আমাদের সঙ্গেই চলুন না !'
'আবার তোমাদের জ্বালাব? দিব্যি দুটিতে এসেছ -'
নরেন একটু লজ্জা পাইল, ' কি যে বলেন ! মোহন তো আসবেই স্টেশনে , তার একটা মোটর আছে, সেটা নিয়েই আসবে। বেশ গল্প করতে করতে
যাওয়া যাবে - এই যে !'
দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলাম। যমজ ভাই
কাছাকাছি চেহারার হইতে পারে জানিতাম,
কিন্তু
এতখানি সাদৃশ্য কখনও চোখে পড়ে নাই। লম্বায়-চওড়ায় মুখের গড়নে হাত পায়ের গঠনে অদ্ভুত
মিল। নরেন আলাপ করাইয়া দিল,' আমার ভাই, মোহন। মোহন, ইনি অমরদা, আমাদের কলেজেই পড়তেন ।'
মোহন নমস্কার করিল। লক্ষ্য করিলাম, তাহার চোখের দৃষ্টিটা অস্বাভাবিক
তীক্ষ্ণ, যেন সামনের লোকটির অন্তঃস্থল পর্যন্ত
দেখিয়া লইতে চায়। এমন দৃষ্টির সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াইতে গা শিরশির করে, অস্বস্তি হয়।
নরেন বলিল, 'মোহন,
তোর্
মোটর এনেছিস তো? দাদাকে পথে নামিয়ে দেব তাহলে, কি বলিস? আপনার বাড়িটা যেন কোথায়, দাদা?'
জায়গাটার নাম বলিলাম। মোহন একটু
হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, 'ও তো পথেই পড়বে, অসুবিধা হবে না -আসুন।' দুই ভাইয়ের গলার স্বরেও খুব একটা
পার্থক্য নাই।
পাহাড়ি পথে গাড়ি ঘুরিয়া ঘুরিয়া উঠিতে
লাগিল। একপাশে কঠিন পাথর, অন্যদিকে গভীর খাদ সোজা নামিয়া
গিয়াছে। পাহাড়ের ঢালে পাইন ও দেবদারু গাছের সমারোহ,
কোথাও
বা ক্ষীণ পাহাড়ি ঝর্ণা শিলাস্তুপের কাঠিন্য ভেদ করিয়া আত্মপ্রকাশ করিয়াছে।
মোহন গাড়ি চালাইতেছিল। লক্ষ্য করিলাম, ছোকরার হাত বেশ ভালো। নরেন বলিল, 'দিব্যি শিখেছিস তো! খুব চালাস বুঝি?' মোহন গোমড়ামুখে জবাব দিল, ' নিজে না চালালে খরচায় কুলোবে না, ব্যবসা করে যা আসছে সব ড্রাইভারের
পিছনেই যাবে ।'
গাড়ি আরেকটা মোড় ঘুরিবার পূর্বেই একটা
ঘটনা ঘটিল। ইন্দিরার পায়ের কাছে কোকো নিশ্চিন্তমনে নিদ্রা যাইতেছিল, গাড়ির ঝাঁকুনিতেই হউক বা অপরিচিত
গলার আওয়াজেই হউক, তাহার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়া গেল। ক্ষুদ্র
মুন্ডটি উঁচাইয়া সে সশব্দে আপন অসন্তোষ ঘোষণা করিল।
সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝাঁকুনি দিয়া
গাড়িটা থামিয়া গেল। মোহনের দিকে তাকাইয়া দেখি তাহার হাত স্টিয়ারিঙের উপর থর থর
করিয়া কাঁপিতেছে, চোখ দুইটা যেন ঠিকরাইয়া বাহির হইয়া আসিতেছে। ভাঙা ভাঙা গলায় সে চীত্কার
করিতে লাগিল 'কুকুর নিয়ে এসেছিস তোরা? উঃ - কুকুর নিয়ে এসেছিস?' উত্তেজনায় তাহার মুখটা লাল হইয়া
উঠিতেছিল।
নরেন নিতান্ত অপরাধীর মতন মুখ করিয়া
বলিল, 'আসলে ওকে ছাড়া - মানে, ইন্দুকে ছাড়া - থাকতে পারে না তো, আমরা
চলে এলে হয়তো না খেয়েই মরে যাবে। আর রেখে আসবটাই বা কার কাছে? এক পিসিমার কাছে দিয়ে আসা যেত, কিন্তু বিমলের ছেলেটা যা আকখুটে, হয়তো ঢিল মেরে পা-টাই ভেঙে দেবে। এই
তো কটা দিন, কোনো ঝামেলা করবে না দেখিস।' ইন্দিরা আদুরে গলায় যোগ করিল, ' ওর সঙ্গে খেলা করলে সব ভয় ভুলে যাবেন
আপনি। ব্ড্ড লক্ষ্মী ছেলে কোকো -'
মোহন
তাহার দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ
করিয়া পুনরায় স্টীয়ারিং-এ হাত দিল।
তারপর টুকটাক কথা চলিতে লাগিল, কিন্তু কোথাও যেন তাল কাটিয়া গিয়াছিল, কেহই স্বচ্ছন্দ হইতে পারিলাম না।
মিনিট পনের-কুড়ি পরে গাড়ি আমার বাড়ির নিকটে আমায় নামাইয়া দিলে হাঁফ ছাড়িলাম ।
যাওয়ার আগে নরেন ও ইন্দিরা একদিন আসিতে সনির্বন্ধ অনুরোধ করিয়া গেল।
---------------------
বাড়িতে ঢুকিয়া চক্ষুস্থির! প্রায় বছরখানেক আসা হয় নাই, সেই অবসরে শ্রীমান রামাবতার কতিপয়
দেশোয়ালী ভাই জুটাইয়া একতলার বসিবার ঘরে একটি মনোরম আধ্যাত্মিক আড্ডা বসাইয়াছেন।
তাঁহাদের জনা দুয়েক সোফার উপর আপন শ্রীচরণ স্থাপন করিয়া সদালাপে ব্যস্ত ছিলেন, আমাকে দেখিয়া জিভ কাটিয়া পলায়ন
করিলেন। দেখি,দামী কার্পেটটা ধূলায় ধূসর হইয়া
গিয়াছে,গাঁজার কলিকা গড়াগড়ি খাইতেছে। আড্ডার
হোতা আমাকে দেখিয়া সচকিত হইয়া উঠিলেন এবং অনতিবিলম্বে সম্মার্জনী হস্তে গৃহের
সংস্কারসাধনে প্রবৃত্ত হইলেন।
ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত জ্বলিয়া
উঠিয়াছিল, ইচ্ছা করিতেছিল সেই দণ্ডেই কান ধরিয়া
ব্যাটাকে বিদায় করি। কিন্তু লোকটা চলিয়া গেলে নিজেকে রাঁধিতে হইবে, নূতন লোক কবে পাওয়া যাইবে তাহার
স্থিরতা নাই। উপরন্তু লোকটা টাকাপয়সার ব্যাপারে বিশ্বাসী। এসব ভাবিতে ভাবিতে সোফায়
বসিয়া একটি সিগারেট ধ্বংস করিলাম। ইতিমধ্যে রামু চা আনিয়া হাজির করিল।
বাড়িটাকে বাসযোগ্য করিতে, বাজার আনাইতে দিনটা কাটিয়া গেল। এই
কর্মকান্ডে পরিশ্রান্ত হওয়া উচিত বিবেচনা করিয়া পরের দিনটা বিছানায় গড়াইলাম। তৃতীয়
দিনে ঘুম ভাঙিয়া দেখি, দিব্য রৌদ্র উঠিয়াছে। মন ভাল হইয়া
গেল। চা, সিদ্ধ ডিম, কেক প্রভৃতি সাত্ত্বিক বস্তু দিয়া
প্রাতঃরাশ সমাধা করিয়া বেড়াইতে বাহির হইলাম। রামু জানাইল, সে মুরগির 'কারী'
রাঁধিতেছে, আমি যেন জলদি লৌটিয়া আসি।
আমাদের বাড়িটি পাহাড়ের কিছুটা উপরে।
জায়গাটা মোটামুটি নির্জন, আশেপাশে বসতি কম। কিছুদূর নামিয়া
আসিলে পাহাড়ের গায়ে খানিকটা সমতল এলাকা । চারপাশে বাড়িঘর আছে, সকালের দিকে একটি ছোটখাট বাজার বসে।
স্থানীয় লোকজন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে,
ভ্রমণার্থীরাও
অল্পস্বল্প কেনাকাটা করেন।
দেখিলাম,বাজারটা যেন আগের বারের তুলনায় বেশি
গমগম করিতেছে। তরিতরকারীর দোকানে বেশ ভীড়
| চায়ের
দোকানে জল ফুটিতেছে, কয়েকটা হতশ্রী কুকুর বিস্কুটের আশায়
ঘুরঘুর করিতেছে। শাল, পুঁতির মালা, কম্বল,
সোয়েটার, কাঠের খেলনা প্রভৃতির বেচাকেনা
চলিতেছে । কয়েকজন বৃদ্ধ আপাদমস্তক শীতবস্ত্রে আবৃত করিয়া বেঞ্চিতে বসিয়া বর্তমান
সমাজের অধোগতি সম্পর্কে রসালাপ করিতেছেন, ভাষাটা বাংলা । বুঝিলাম, বায়ুপরিবর্তন-মানসে আগমন করিলেও
দেশের বায়ু সঙ্গে আনিতে ভোলেন নাই ।
একখানা জমকালো শাল কিনিয়া লওয়া উচিত
কিনা এবং সেটা গায়ে দিলে কলিকাতায় সঙের মতন দেখাইবে কিনা ভাবিতেছি, এমন সময় শুনি, ' দাদা,
আপনি
এখানে ?'
চাহিয়া দেখি,
ইন্দিরা।
স্বাস্থ্য এই কদিনে ভালো হইয়াছে,
গালে
লালের ছোপ, মুখখানা ঝকঝকে। আমাকে প্রায় টানিতে
টানিতে একটা দোকানে উপস্থিত করিল। নরেন দাঁড়াইয়া ছিল, তাহার প্রতি একটি কটাক্ষ করিয়া বলিল, 'এখনও তো পছন্দ করে উঠতে পারলে না, তাই দাদাকে ধরে নিয়ে এলাম- দাদা, দিন তো পছন্দ করে ।' বলিয়া দোকানে রক্ষিত নানাবর্ণের
পাথরের মালার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল ।
দেখা গেল, ইন্দিরার পছন্দ টুকটুকে লাল, কিন্তু নরেনের ধারণা সে রংটা
ক্যাটকেটে, হালকা নীল রঙেই তাহাকে মানাইবে বেশি।
বোনের সঙ্গে দোকানে ঘুরিবার অভিজ্ঞতা ছিল,
অতএব
নরেনকে দুইটিই কিনিয়া ফেলিবার পরামর্শ দিলাম। ইন্দিরা মুখভঙ্গী করিয়া বলিল, 'দেখেছ,
উনিই
ঠিক বোঝেন ।'
রৌদ্র ক্রমশ প্রবল হইয়া উঠিতেছিল,ফিরিবার প্রস্তাব করিতেই ইন্দিরা হাঁ
হাঁ করিয়া উঠিল ।
'যাবেন বললেই হল? সেদিন কত করে বললাম, এর মধ্যে একবারও আসার সময় হল না - আজ কিছুতেই ছাড়ব না, একেবারে দুপুরে খেয়ে তবে ফিরতে পাবেন।'
নরেনও
মৃদু সমর্থন করিল ।
কোনমতে বুঝাইলাম, রামু খানা পাকাইয়া রাখিবে, না খাইলে অভিমানে হয়ত রাতে রাঁধিবেই
না । (ঈশ্বর জানেন, রামু মুরগি ভিন্ন যাহা রাঁধে তাহা
গলাধঃকরণ সহজ নয় ) তখন কি আমি জল খাইয়া থাকিব? কিঞ্চিত মান-অভিমানের পর স্থির হইল আমি পরের দিন
রাত্রে নৈশভোজে অতিথি হইব, তবে এখনকার মতন গিয়া চা পান করিয়া
আসতে হইবে।
বাজারটা যেখানে শেষ হইয়াছে, সেখানে একটা মোড় ঘুরিয়া কিছুদুর উপরে
উঠিলে মোহনের বাড়ি। ছিমছাম একতলা বাড়ি, সামনে অল্প বাগান আছে।আশেপাশে তেমন বসতি নাই, একপাশে কিছুদুর গেলে গভীর খাদ। স্বাস্থ্যবান একটি স্থানীয় লোক দরজার
সামনে টুলে বসিয়া ঝিমাইতেছিল,
আমাদের
পায়ের শব্দে নড়িয়া উঠিয়া দরজা খুলিয়া দিল।
লক্ষ্য করিলাম,তাহার অপ্রসন্ন দৃষ্টি আমাকে অনুসরণ
করিতেছে । ইন্দিরা ফিস ফিস করিয়া বলিল, 'মোহনদার খাস বেয়ারা । লোক ভালো, কিন্তু এমন তাকায় , মাঝে মাঝে ভয় করে।'
বসিবার ঘরে আসবাবের বাহুল্য নাই, যতটুকু না হইলে নয় ততটুকুই রহিয়াছে। একটা সোফা, একপাশে একটা তক্তপোষ, একটা গোল টেবিল। তবে দেওয়াল জুড়িয়া আলমারিতে বই বোঝাই। গৃহস্বামীর মনের গতি বুঝিতে অসুবিধা
হয় না।
কয়েকবার ডাকাডাকির পর মোহনের সাড়া না
পাওয়ায় নরেন বলিল, 'তাহলে নির্ঘাত সেই ল্যাবরেটরী ঘরে
ঢুকেছে। উঃ,
কি
কাজপাগল যে - নাওয়া খাওয়ার ঠিক থাকে না - যাই দেখি ডেকে আনি ।'
এই তরুণ তাপসের সাধনায় বিঘ্ন ঘটাইতে
ইচ্ছা করিল না, প্রস্তাব
করিলাম আমিই বরং তাহার সঙ্গে দেখা করিয়া আসি। নরেন রাজি হইল ঠিকই, কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া মনে
হইল মোহনের সামনে না যাইতে হইলেই সে স্বস্তি পাইত।
মোহনের ল্যাবরেটরী বাড়ীর পিছনের
জমিতে। ইঁটের গাঁথনি, টিনের চাল, নিতান্ত অনাড়ম্বর ব্যাপার। দরজায় টোকা দিতে মোহন বাহির হইয়া
আসিল। তাহার চুল উস্কোখুস্কো, পরনের এপ্রনে স্থানে স্থানে ছিদ্র, হাতের শিশিতে একটা ফিকা হলদে রঙের
তরল । আমাদের দেখিয়া সে থতমত খাইয়া দাঁড়াইল
। ইন্দিরা কলকল করিয়া উঠিল , ' আজ দাদাকে ধরে নিয়ে এলাম। এখানে চা খেয়ে যাবেন ।'
মোহন কেমন অসংবৃত ভাবে বলিল , 'তা ভালোই তো - আসলে আমি কাজ করছিলাম - ' ভাবে বোধ হইল অতিথিকে মনোযোগ দিবার
মতন অবস্থা তাহার নাই। আর কথা না বাড়াইয়া বিদায় লইলাম।।
বাড়ীতে ফিরিয়া ইন্দিরা একটা হুল্লোড়
বাধাইয়া তুলিল। আধ
ঘণ্টার ভিতর চা, ডালমুট, কেক,
নানখাটাই
প্রভৃতিতে টেবিল বোঝাই করিয়া ফেলিল এবং একটুও অবশিষ্ট রাখিলে হাঙ্গামা করিবে বলিয়া
শাসাইল । কথায় কথায় নরেন বলিল, 'মোহন যে কি করে, নাওয়া খাওয়ার কোনো ঠিক নেই , হয়ত কোনদিন ওখানেই থেকে গেল। মাঝে মাঝে তাও ইন্দু গিয়ে বুঝিয়ে
খেতে ডেকে আনে । এমন করলে কবে বিছানায় পড়ে তাই ভাবি।'
ইন্দিরা
বলিল, ' মোহনদার জন্যে একটা মেয়ে দেখুন না
দাদা । আমরা চলে গেলে কেই বা যত্ন করবে, অসুখ-বিসুখে কেই বা দেখবে ?' তাহাকে একটু রাগাইতে ইচ্ছা করিল, বলিলাম,, ' দিব্যি বলেছ ! যে লোক দিন রাত কাজে ডুবে থাকে সে
বউকে দেখবে কখন? শুধু শুধু একটা মেয়েকে কষ্ট দেওয়া হবে
কেবল ।'
ইন্দিরা
ভ্রূ -এর একটা ভঙ্গী করিল । বলিল,
' ইস , তাই বই কি! দেখবেন তখন এসে । কাজকর্ম সব ঘুচে যাবে, দিনরাত বউকে চোখে হারাবেন । আসলে আমরা জোগাড় করছি
না তাই বলতে পারছেন না।'
ভাবিলাম, হইবেও বা। হয়ত নবদম্পতিকে দেখিয়া ব্রহ্মচারীর
চিত্তবৈকল্য ঘটিয়াছে । এসব ব্যাপারে মেয়েদের চোখ এড়ানো কঠিন
।
উঠি
উঠি করিতেছি, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়িল । জিজ্ঞাসা করিলাম, ' আচ্ছা
, কোকোকে
দেখছি না? সে গেল কোথায় ? '
ইন্দিরা
মুখ ভার করিয়া বলিল ,' আর বলবেন না দাদা। মোহনদাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না, কেবল তেড়ে কামড়াতে যায়, শেষে পিছনের ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখতে
হল ।‘
----------------------
পরদিন
সকালে
ঘুম ভাঙিয়া দেখি, আকাশের রং কালো, মধ্যে মধ্যে গুরগুর
করিয়া মেঘ ডাকিতেছে । বৃষ্টির সম্ভাবনায় উত্ফুল্ল হইয়া
উঠিলাম। চায়ের পেয়ালা নিঃশেষ করিয়া ঠ্যাং
নাচাইতেছি , এমন সময় শ্রীমান রামেশ্বর আসিয়া
হাঁড়ির মতন মুখ করিয়া জানাইলেন,
কাল
সারারাত বৃষ্টি হইয়াছে, আজ বাজার বসে নাই। ঘরে কেবল এক দিনের মতন চাল ডাল আলু
এবং ডিম আছে । বৃষ্টি না থামিলে পরের দিন উপবাস
করিতে হইবে।
রাষ্ট্রভাষায়
তাহার চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধার করা উচিত হইবে কি না ভাবিতেছি, এমন সময় মনে পড়িল, আজ রাত্রে নিমন্ত্রণ আছে । কথাটা মনে হইতেই কিঞ্চিত প্রশান্ত
বোধ করিলাম ।রামুয়ার ফাঁড়াটা কাটিয়া গেল। খিচুড়ির অর্ডার দিয়া পুনরায় লম্বা
হইলাম।
যথোচিত
সাজসজ্জা করিয়া সাতটা নাগাদ বাহির হইলাম। পৌঁছিয়া দেখি, বাড়ীটা কেমন যেন চুপচাপ। আগের দিনের
দ্বাররক্ষী নাই, শব্দ করিলে ইন্দিরা আসিয়া দরজা খুলিল । তাহার মুখখানা
বিষণ্ন, সে উচ্ছল ভাব নাই। জিজ্ঞাসা করিলাম , 'কী
ব্যাপার, কারুর সাড়াশব্দ পাচ্ছি না যে ? তোমার কর্তাটি গেলেন কোথায় ?'
'সকাল থেকেই মাথা ধরেছে বলে শুয়ে আছেন, বিকেলে চা খেয়ে আবার একটু শুয়েছেন ।' তারপর কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া
বলিল, 'জানেন দাদা, কোকোকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।'
'সে কি! ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলে বলছিলে, তাহলে গেল কোথায় ?'
'কি জানি! কাল রাতে খাইয়ে দরজা বন্ধ করেছিলাম, সকালে গিয়ে দেখি দরজা খোলা ,
কোকো
নেই ।'
'তাহলে হয়ত দরজাটা ঠিকমত বন্ধ হয়নি ।
নরেন জানে না কিছু?'
'উনি আজ একটু ভোর ভোর উঠেছেন। মোহনদা
গাড়ি নিয়ে টাউনে গেলেন, তাই। তখন বোধ হয় খেয়াল করেন নি।'
'মোহন টাউনে গেল এই বৃষ্টিতে?' টাউন বা নিকটবর্তী শহর গাড়ীতে প্রায়
ঘন্টা চারেকের রাস্তা।
'কি জানি, বলছিলেন খুব জরুরী কাজ। আজ বোধ হয়
ফিরতে পারবেন না। কোকোকে পাওয়া যাবে তো,
দাদা ?'
উত্তর
দিতে পারিলাম না । পাহাড়ে বৃষ্টি কি সাংঘাতিক হয় জানিতাম, তাহার মধ্যে অতটুকু কুকুর হারাইয়া
গেলে তাহার ফিরিয়া আসার সম্ভাবনা কতটুকু
সেটাও অজানা ছিল না। কিন্তু এই মেয়েটিকে আঘাত দিতে ইচ্ছা করিল না।বলিলাম , 'দেখ কোথাও আটকে পড়েছে । কাল নিশ্চয়
ফিরে আসবে ।
তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবে নাকি ? কাল সকালেও না ফিরলে বরং আশেপাশে
খোঁজ করে দেখা যাবে।' সে আর কিছু বলিল না বটে, কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া মনে হইল সে
নিশ্চিন্ত হয় নাই। কিছুক্ষণ পরে বলিল,
'আপনি
একটু বসুন, আমি একবার ওদিক থেকে আসি। দেখি উনি
উঠেছেন কি না ।'
একটা বই লইয়া বসিলাম। ভিতরের দরজাটা খোলা ছিল,
কানে
আসিল, ইন্দিরা স্বামীকে বলিতেছে ,' একবার
যাও না, উনি একা বসে আছেন, আমাকে তো রান্নাঘরে যেতে হবে একবার ।' উত্তরে নরেন কি বলিল শুনিতে পাওয়া
গেল না, কিন্তু ইন্দিরা আবার তাড়া দিল, ' ওঠো না লক্ষ্মীটি, একবার যাও - ও ঠো -'
এবার নরেনের গলা শুনিলাম, ' আঃ ,
কেন
জ্বালাতন কর - বলছি তো মাথা ধরেছে,
যাও
না তুমি গল্প কর গিয়ে। নিজে নেমন্তন্ন
করেছ, আমি কি করব ?' আশ্চর্য হইয়া গেলাম। নরেন স্বভাবত মৃদুভাষী, সে এমন কঠিন করিয়া বলিতে পারে জানা
ছিল না। মনে হইল, দূর হোক ছাই, কোনোমতে বাহির হইতে পারিলে বাঁচি।
নিমন্ত্রণ পাওয়ামাত্র হ্যাংলার মতন আসিয়াছি ভাবিয়া নিজের উপর রাগ হইতে লাগিল।
ইন্দিরা বেশ চটপটে, মিনিট চল্লিশের মধ্যে আসিয়া জানাইল, খাবার তৈরী, এবার বসিয়া পড়িলেই হয়। মৃদুস্বরে
কহিল, ' কিছু মনে করবেন না, এতক্ষণ বসিয়ে রাখলাম । ওঁর শরীরটা ভাল নেই বলে উঠতে পারলেন না -'
রান্নাঘরের লাগোয়া অল্প একটু খাওয়ার
জায়গা, একটি নড়বড়ে টেবিল ও গোটাকয়েক চেয়ার।
বসিতে ইতস্তত করিতেছি দেখিয়া ইন্দিরা হাসিয়া ফেলিল,
' ভয়
নেই,এগুলো দেখতে বদখত হলেও বেশ পোক্ত, ভাঙবে না। মোহনদা কোত্থেকে এগুলো
জোগাড় করেছেন উনিই জানেন।'
আহার্য উপস্থিত হইল। লুচি, ,ছোলার ডাল, একটা তরকারি, ডিমের ডালনা। একপাশে একটা পুডিংয়ের
বাটিও চোখে পড়িল। তারিফ করিয়া বলিলাম,
'তুমি
বেশ কাজের মেয়ে তো ! একা এত সব করেছ!'
ইন্দিরা লজ্জা-লজ্জা হাসিল, ' কোথায় আর এত করলাম! তরকারি তো পাওয়াই
যায় না, বৃষ্টি হয়ে আরও মুশকিল হয়ে গেল।
দেখুন না, মাংসের বদলে ডিম খাওয়াতে হল। তবু
ভাগ্যিস ডিম ছিল ঘরে।'
মনে মনে হাসিলাম। সকলেই ঘরে ডিম
থাকাতে উপকৃত হইয়াছে।
পুডিংয়ের দিকে হাত বাড়াইয়াছি, এমন সময় নরেন ঘরে ঢুকিল। আমার দিকে
তাকাইয়া থামিয়া থামিয়া বলিল,
'আসলে একটু মাথা ধরেছিল তো , তাই - ঠিক করে খেয়েছেন তো?' এই একদিনে তাহাকে যেন আরও রোগা
দেখাইতেছে, দুই চোখে একটা অস্বাভাবিক দীপ্তি।
তাহার অস্থির দৃষ্টি একবার ইন্দিরার,
একবার
আমার মুখে ঘোরাফেরা করিতেছিল। একটা অস্বস্তি বোধ করিতেছিলাম। কাল যে অত আপ্যায়ন
করিল, আজ সে এমন বিরূপ হইয়া উঠিল কেন?
আমার খাওয়া শেষ হইয়া গিয়াছিল, ইন্দিরা নরেনকে জিজ্ঞাসা করিল, 'তোমায় খেতে দেব ?' সে কতকটা অন্যমনস্কের মতন বলিয়া উঠিল
, ' না না - আমি খাব না - তুমি খেয়ে নাও
- ওনাকে দেখো, উনি তো ফিরবেন -' বলিয়া টলিতে টলিতে ঘরে ফিরিয়া গেল |
আপাদমস্তক জ্বলিয়া গেল। কেন রে বাপু, ডাকিয়া আনিয়া অপমান করা? আর এক মুহূর্ত দাঁড়াইতে ইচ্ছা করিতেছিল না,
ইন্দিরাকে
বলিলাম, ' আমি তাহলে আসি, তোমাদের খাওয়া দাওয়া হয়নি, নরেনের শরীরটাও ভালো নয়- '
ইন্দিরা কিছু একটা বলিতে যাইতেছিল, হঠাত কড়কড় করিয়া প্রবল শব্দে বাজ
পড়িল। বসিবার ঘরে জানালা খোলা ছিল,
দেখি
- সর্বনাশ! আমি যতক্ষণ বৃষ্টি হইবে না ভাবিয়া নিশ্চিন্তে লুচির শ্রাদ্ধ করিতেছিলাম, বরুণদেব তত্ক্ষণে তাঁহার সৈন্যসামন্ত
লইয়া অবতীর্ণ হইয়াছেন। মিনিট পাঁচেকের ভিতর প্রবল বর্ষণ আরম্ভ হইয়া গেল।সে কী
বৃষ্টি! জলের ধারা প্রচন্ড আক্রোশে আছড়াইয়া পড়িতেছে,
বাহিরে
কিছু দেখা যায় না। এক মুহুর্তের জন্য
দরজাটা খুলিয়াছিলাম, এক ঝাপটায় পাঞ্জাবীটা অর্ধেক ভিজিয়া
গেল।
এমন অবস্থায় অপেক্ষা ভিন্ন উপায় থাকে
না । আমার সঙ্গে ছাতা নাই, থাকিলেও এই বৃষ্টির মোকাবিলা করার
সাহস হইত কি না সন্দেহ। বোকার মতন বসিয়া রহিলাম। ইতিমধ্যে আলোও চলিয়া গেল।
ঘন্টা দেড়েক পরেও যখন বৃষ্টি থামিবার
কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, তখন বাধ্য হইয়া বলিলাম, ' ভাবছিলাম কি, এই বেলা বরং এগিয়ে যাই।এইটুকু তো
রাস্তা, কোনরকমে চলে যাব। রাত হয়ে গেছে, তোমরা শুয়ে পড়।' নরেনের বিরক্তির কারণ হইতে আর ইচ্ছা
করিতেছিল না।
ইন্দিরা কোনো কথাই শুনিল না। ' যাবেন বই কি! তারপর বৃষ্টিতে
নিমোনিয়া বাধালে কি হবে শুনি?
আজকের
রাতটা থেকে যান, কাল সকালে যাবেন। মোহনদা নেই ,ওঁর পড়ার ঘরটা খালি আছে, ওখানেই শোবেন এখন।'
'নরেনের শরীর খারাপ, তোমাদের অসুবিধা হতে পারে ।'
'উঃ,
আপনি
ভাবতেও পারেন বটে । কোনো কথা নয়,
আসুন, মোহনদার একসেট জামাকাপড় বের করে
দিচ্ছি, ভিজে জামাটা ছেড়ে ফেলুন, আমি ততক্ষণে ঘরটা ঠিক করে দিচ্ছি ।'
মোহনের পড়ার ঘরটি একটি কুঠুরি বলিলেই
হয়। ঘরখানি বইভর্তি আলমারীতে বোঝাই,
মেঝেতে
বইয়ের স্তূপ, একটি সিঙ্গল খাট এককোণে গুটিসুটি
মারিয়া আছে। ঘরের একপাশে জানালা আছে তাই রক্ষা, নহিলে এ ঘরে দমবন্ধ হইয়া মরা বিচিত্র
নয়।
পোশাক পরিবর্তন করিয়া আসিয়া দেখি, ইন্দিরা ঘরখানাকে মোটামুটি বাসযোগ্য
করিয়া তুলিয়াছে। জানালাটা খোলা,বইগুলি ভূমিশয্যা হইতে অব্যাহতি
পাইয়াছে, খাটে পরিষ্কার চাদর পাতা। একটু
কুন্ঠিতভাবে সে বলিল, 'আপনার কষ্ট হবে একটু। কাচা চাদর
এই একটাই ছিল, বোঝেনই তো, মোহনদা একলা থাকেন, কোনো ছিরিছাঁদ নেই একেবারে ।' সে ঘরের কোণে একটা লন্ঠন রাখিয়া গেল।
ইন্দিরা চলিয়া গেলে আলোটা কমাইয়া শয়ন
করিলাম। দরজা বন্ধ করিয়া শোওয়ার অভ্যাস
কোনোকালেই নাই, এখানেও দরজা খোলাই রহিল, কেবল পর্দাটা ফেলিয়া দিলাম। ইন্দিরা বোধ করি রান্নাঘরে কিছু কাজ সারিতেছিল, বাসনের ঠুংঠাং কানে আসিতে লাগিল।
আন্দাজ মিনিট পনেরো পরে শুনিলাম,
পাশের
ঘরে দরজা বন্ধ হইল ।
লুচিটা বোধহয় বেশি খাইয়া ফেলিয়াছিলাম, ঘুম আসিল না। বৃষ্টি থামিয়া গিয়াছে, জানালা দিয়া ঠান্ডা হাওয়া
আসিতেছিল।এপাশ-ওপাশ করিতে করিতে এটা-ওটা হাবিজাবি ভাবিতে লাগিলাম । নরেন অমন
খ্যাঁচখ্যাঁচ করিয়া উঠিল কেন ? কাল
সকাল হইলেই চলিয়া যাইব - ইন্দিরা ভারী ভালো মেয়ে - খুব যত্ন করিতে জানে- প্রবীণা আত্মীয়ারা দেখা হইলেই বলিতেছেন -
বিবাহটা কি করিয়াই ফেলা উচিত?
- কি
করিয়া মেয়ে দেখিতে হয়? - দূর ছাই, মা থাকিলে কি ভালোই না হইত!
চিন্তার আতিশয্যে বোধ করি তন্দ্রা
আসিয়া থাকিবে। বালিশটা জড়াইয়া পাশ ফিরিতে যাইতেছি,
হঠাৎ
একটা তীব্র চীত্কারে ঘুমের আমেজটা ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল। 'না ! ছোঁবে না আমাকে ! 'গলাটা ইন্দিরার ।
নির্ঘাত কোনো দাম্পত্য কলহ, কাল প্রত্যুষে ইহার চিহ্নও থাকিবে না
। কাজ কী আমার চিন্তা করিয়া ।
পুনরায়
শয্যা আশ্রয় করিব , হঠাৎ আর একটা চীত্কারে মাথাটা বনবন
করিয়া ঘুরিয়া উঠিল । ইন্দিরা বলিতেছে '
চলে
যাও এ ঘর ছেড়ে - চলে যাও বলছি! নইলে এখুনি বলে দেব,
সবাইকে
বলে দেব তুমি কে !' প্রত্যুত্তরে একটা চাপা গর্জন,আর্তনাদ, এবং
একটা পতনের শব্দ।
একেবারে লাফ মারিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম।
ইন্দিরা এসব কী বলিতেছে? 'সবাইকে বলে দেব তুমি কে' - এর অর্থ কী? নরেন কি কোনো দুষ্কার্য করিয়াছে ? নাকি কোনো গুরুতর গোপন কথা আছে তাহার
?
বন্ধ দরজার ওপার হইতে ঝটাপটির আওয়াজ
আসিতেছিল। কে যেন সারা ঘরে ছোটাছুটি করিতেছে। ইন্দিরার কন্ঠ শুনিলাম, 'বাঁচাও - উঃ মাগো!'
লন্ঠনটা হাতে নিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম।
নিকুচি করিয়াছে সভ্যতা-ভদ্রতার। নরেনের এত সাহস,
সে
স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে ?
ঘরের সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছি, দরজাটা খুলিয়া গেল। আর বাহির হইয়া
আসিল - ইন্দিরা ! লন্ঠনের আলোয় দেখিলাম,
তাহার
চুল এলোমেলো, পোশাক অবিন্যস্ত, কপালের একটা কোণ কাটিয়া রক্ত
পড়িতেছে।আমায় দেখিয়া সে কাঁদিয়া ফেলিল,
' দাদা, আমাকে বাঁচান।'
নরেন কখন আসিয়া পিছনে দাঁড়াইয়াছে
লক্ষ্য করি নাই। একটা হ্যাঁচকা টানে সে ইন্দিরাকে পিছনে টানিয়া লইল - ' কি পাগলামি করছ ? উনি কি মনে করবেন ?' উত্তেজনায় তাহার গলা কাঁপিতেছিল ।
ইন্দিরা এক ঝটকায় হাত ছাড়াইয়া লইল। 'মিথ্যেবাদী! আমাকে ফাঁকি দেবে? তুমি তো উনি নও !'
একটা পৈশাচিক হাসিতে নরেনের মুখ
ভরিয়া উঠিল । 'হাঁ,
আমি
মোহন, নরেন নই! নরেন একটা গাধা - সকালে
বেরোনোর নাম করে তাকে বোকা বানিয়েছি !’
ইন্দিরা আর্তনাদ করিয়া উঠিল -' কোথায় তিনি? কোথায় রেখেছ তাঁকে?'
‘নরেনকে? সে আমার ল্যাবরেটরীতে রয়েছে - তবে
কাল সকালের পরে আর থাকবে না - হা হা হা ! একটা গ্যাসের বোতলের ছিপি খুলে রেখে
এসেছি - বেশি না - এই একটু একটু করে ফুসফুসে ঢুকবে - আস্তে আস্তে দম বন্ধ হয়ে যাবে - কিন্তু পালাতে
পারবে না। পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছি যে - হা হা হা হা !'
আমার আর সহ্য হইল না। লন্ঠনটা তুলিয়া
এক ঘা দিব, নরেন - থুড়ি, মোহন খানিকটা পিছাইয়া পকেট হইতে কি
একটা বাহির করিল। সভয়ে দেখিলাম,
একটা
রিভলভারের নল আমার দিকে তাক করিয়া আছে।
শয়তানি হাসিতে মোহনের মুখ ভরিয়া গেল।
'কি ভেবেছ, চাঁদ ?
আমায়
মারবে, কেমন ?
তার
আগে তোমায় মারব - দুটো গুলি- ব্যাস! তারপর
টেনে খাদে ফেলে দেব - যেমন ওই কুত্তাটাকে ফেলেছি - হা হা হা - ' নৃশংস আনন্দে তাহার চোখ দুইটা নাচিতে
লাগিল।
ইন্দিরা এতক্ষণ অভিভূতের মত মেঝেয়
বসিয়া ছিল, এবার আকুল হইয়া বলিয়া উঠিল - ' আপনার পায়ে পড়ি, আমাদের ছেড়ে দিন। টাকা-গয়না যা চান দিচ্ছি, কিন্তু ওঁকে মারবেন না , দোহাই আপনার !'
মোহন তাহার দিকে ফিরিল। ভূতে-পাওয়ার
মত বলিল -' গয়না?
টাকা? না - আমি তোমাকে চাই, তোমাকে! ভেবেছিলাম তোমার বাবাকে বলব, তার আগেই কি সব হয়ে গেল । এই জন্যেই
তো চিঠি লিখে তোমাদের আনালাম| এবার পেয়েছি, আর ছাড়ব না- '
'চুপ করুন, চুপ করুন আপনি -'
'কেন?
বাঁদরের
গলায় মুক্তোর মালা মানায় না - কিসের জন্য পড়ে থাকবে নরেনের কাছে? কি আছে তার ? ভুলে যাও, তোমায় আমি খুব ভালোবাসব -'
'মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার - মরে
গেলেও আপনার কথা মানব না আমি ।'
মোহন আর একবার অট্টহাস্য করিল।
মুহূর্তের জন্য তাহার দাঁতগুলা অন্ধকারে ঝিকমিক করিয়া উঠিল - যেন ভালোমানুষীর মুখোশটা খুলিয়া ভিতরের
শ্বাপদটা তাহার নখদন্ত প্রকাশ করিল
। চিবাইয়া
চিবাইয়া বলিল, 'মরে গেলেও শুনবে না, বটে?
তবে
মরো !' রিভলভারের নলটা সে ইন্দিরার দিকে
ফিরাইল। ' দ্যাখো মরতে কেমন লাগে। ওয়ান , টু -'
আর কিছু বলিবার পূর্বেই অন্ধকার হইতে
একটা কি যেন প্রচন্ড গর্জন করিয়া তাহার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িল । আমার বোধবুদ্ধি লোপ
পাইয়াছিল, হতভম্বের মতন দেখিলাম, সেটা একটা প্রকান্ড কালো কুকুর !
কোথা হইতে আসিল - কেমন করিয়া ভিতরে আসিল এ ?
কুকুরটা মোহনকে মাটিতে ফেলিয়া তাহার
বুকের উপর পা তুলিয়া দাঁড়াইল। তাহার চোখ দুইটা মোহনের মুখ হইতে সরিতেছে না,গলায় শব্দ হইতেছে - গর গর গর -
মোহনের হাতে রিভলভারটা তখনো ধরা ছিল।
হাতটা সে ধীরে ধীরে উপরে তুলিতেছিল। কুকুর নড়ে নাই,
একদৃষ্টে
তাকাইয়া আছে। নলটা কুকুরের দিকে ফিরাইয়া ট্রিগারে আঙুল রাখিতেই কুকুরটা ঘ্যাঁক
করিয়া তাহার কবজিটা কামড়াইয়া ধরিল। মোহন গোঙ্গাইতে লাগিল, কুকুর তাহার দংশন শিথিল করিল না।
বাধ্য হইয়া মোহন রিভলভারটা ফেলিয়া দিতেই কুকুরটা হাত ছাড়িয়া দিল। দেখিলাম, তাহার হাত হইতে টপ টপ করিয়া রক্ত
পড়িতেছে ।।
আশ্চর্য মোহনের মনের জোর! ভয়ে তাহার
মুখ শুকাইয়া গিয়াছে, চোখ দুইটা বিস্ফারিত, সেই অবস্থাতেও সে মুখে আওয়াজ করিয়া
কুকুরটাকে তাড়াইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কুকুরের ভাবান্তর নাই,সে একবার লেজ নাড়াইয়া মোহনের বুকের
উপর থাবা পাতিয়া বসিল । যেন তাহার কোনো তাড়া নাই,
কেবল
খেলা করিতে আসিয়াছে ।
এবার মোহনের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙিল ।
কুকুরটাকে একটা অশ্রাব্য গালি দিয়া সে বলিল,
' বুঝেছি
এসব কার কারসাজি। একটা কুকুর এনে শান্তি
হয়নি, আবার আরেকটাকে ঢুকিয়েছে আমায় ভয়
দেখাতে । দাঁড়াও, এই
(ছাপার অযোগ্য)টাকে বিদায় করে নি, তারপর তোমার মজা দেখাচ্ছি ।শেষ করে
ফেলব একেবারে -' তাহার কথা শেষ হইতে না হইতেই কুকুরটা লাফাইয়া উঠিয়া তাহার টুঁটি
কামড়াইয়া ধরিল ।
মোহনের মর্মান্তিক আর্তনাদে বাড়িটা
কাঁপিতে লাগিল । দুই হাতে সে কুকুরটাকে সরাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল, কুকুর কামড় আলগা করিল না , বরং দ্বিগুণ আক্রোশে দাঁত বসাইয়া
দিল।
এমন ভয়ংকর দৃশ্য আগে কখনও দেখি নাই, স্নায়ু অসাড় হইয়া আসিতেছিল। সামনে
যেন কোনো কুত্সিত নাটকের অভিনয় চলিতেছে,
নীরব
দর্শক হইয়া থাকাই আমার নিয়তি। চাহিয়া দেখি,
ওপাশে
ইন্দিরা মূর্ছিত হইয়া পড়িয়াছে।
মোহনের তখন বড় করুণ অবস্থা । গলার দিকে তাকানো যায় না, মেঝেয় রক্তের স্রোত বহিতেছে । সেই
অবস্থায় সে কোনমতে বলিল, ' বাঁচাও - গুলি -গুলি করো -'
এই পাষন্ডকে রক্ষা করিবার ইচ্ছা ছিল
না, তবু তাহার অবস্থা দেখিয়া দয়া হইল ।
নিচু হইয়া রিভলভারটা তুলিতে যাইব,
কুকুরটা
মুখ তুলিয়া আমার দিকে চাহিল । তাহার দুই কষ বাহিয়া টাটকা রক্ত গড়াইতেছে, চোখে বিশ্বের জিঘাংসা | দাঁত বাহির করিয়া সে বলিল , গ র র র র –
রিভলভারের আশা ত্যাগ করিতে হইল ।
সোজা হইয়া তাকাইয়া দেখি, মোহনের ঘাড়টা একপাশে ঝুলিয়া গিয়াছে, দেহে প্রাণ নাই।
কুকুরটা লাফাইয়া মেঝেতে নামিল, তারপর লেজ নাড়িতে নাড়িতে আমার দিকে
অগ্রসর হইতে লাগিল। তাহার ভঙ্গীটা ঠিক আক্রমণাত্মক নয়, যেন পরিচিত কাহাকেও দেখিয়াছে ।
আমার হাত পা ঠান্ডা হইয়া গিয়াছে, আতঙ্কে মাটিতে বসিয়া পড়িলাম ।
কুকুরটা কাছে আসিয়া আমাকে শুঁকিল ।
রক্তের গন্ধ ! তারপর আমার গালটি চাটিয়া দিল ।
জ্ঞান হারাইবার পূর্বমুহুর্তে খেয়াল
করিলাম, তাহার গলায় লাল রিবন বাঁধা ।
কোকো !
----------------------
বাকি রাত্রিটা কিভাবে কাটিল, সে আর না বলিলেও চলে। ইন্দিরার জ্ঞান
ফিরিলে সে আমার মুখেচোখে জল ছিটাইয়া আমাকে সুস্থ করিল। দেখি,আলো আসিয়াছে । দুজনে মিলিয়া
ল্যাবরেটরীর তালা ভাঙিলাম। নরেন প্রায়
অচেতন হইয়া পড়িয়া ছিল, তাহার বাঁধন খুলিয়া টানিতে টানিতে
বাড়িতে আনা হইল। কিছুক্ষণ মুখে জলের ছিটা দিবার পর সে চোখ খুলিল।
ইন্দিরা দিব্যি শক্ত মেয়ে, এত বিপদেও সে বুদ্ধি হারায় নাই । তাহারই পরামর্শে মোহনের মৃতদেহটা
চাদরে জড়াইয়া খাদে ফেলিয়া দিলাম। কেহ জিজ্ঞাসা করিলে বলিলেই চলিবে, মোহন টাউনে গিয়াছিল, ফেরার পথে দুর্ঘটনায় প্রাণ
হারাইয়াছে।
সবে ভোর হইতেছিল, ফিরিবার পথে শুনিতে পাইলাম, একটা কুকুর ডাকিতেছে। ঠিক পোষা কুকুর
খুশি হইলে যেমন ডাকে, তেমনি ।
Story composed by +anwesha sengupta for Jhaalmuri Puja Special 2014
খুব সুন্দর গল্প। কোনও বাহুল্য নেই, ঠিক যেটুকু প্রয়োজন সেইটুকু লেখা। লেখার ভাষাটাও খুব ভালো হয়েছে।
ReplyDelete